DEHLIJ

ডা. চঞ্চল ভট্টাচার্য

 আরাবল্লীর দেশে, আমার যাপন

ডা. চঞ্চল ভট্টাচার্য



তা হয়ে গেল প্রায় সাতাশ বছর, লট বহর নিয়ে এই রুক্ষ আরাবল্লীর দেশে পদার্পনের। চাকরি করতে এলাম। সঙ্গে অনেক ভালো না লাগা। কোথায় আমার শ্যামল বাংলা, আর কোথায় বাবলা গাছের কাঁটাঝোপে ভরা দিল্লি! বুকের মাঝে বাংলা নিয়েই প্রানপনে মানিয়ে নেওয়ার সময় ছিলো যুদ্ধ। পদেপদে হেনস্থা, ঠকিয়ে দেওয়া, ভাড়াবাড়ির বিষময় অভিজ্ঞতা আমার ঝোলা ভরে দিতে লাগলো।

দিল্লি কিন্তু ফেরালো না আমায়। বরং শিখিয়ে দিলো, কিভাবে টিকে থাকতে হয়। এখানে কুতুব মিনারের উচ্চতা, লালকেল্লার আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা পায়রারা, আমায় বলে যেতো, ফিরো না। মাটি কামড়ে পড়ে থাকো। এ মাটি রুক্ষ হলেও, একদিন ঠিক রস খুঁজে পাবে।

একের পর এক বাড়ি বদল, আমায় ভেতর থেকে স্থিতু হতে দিচ্ছিল না। বসন্ত কুঞ্জে যখন সরকারি হাসপাতালের কোয়ার্টারে এলাম, তারপর ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া বাতাস লাগলো মনে। লিখতে শুরু করলাম আবার সেই ২০০৮ থেকে। বুঝলাম, আমার মনের মাঝে যে বাংলা লুকিয়ে থাকে, তাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে কলম ধরতে হবে। সত্যি বলতে কি, মহকুমা শহরে বেড়ে ওঠা, চির রোম্যান্টিক আমার অনেকটা মুক্তির আস্বাদ এই কবিতা ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকলো।

ব্যস্ত নাগরিক জীবন, ডাক্তারির ফাঁকে ফাঁকে, সুযোগ পেলেই চলে যাই সুরজকুন্ডের জঙ্গলে। চুপচাপ বসে বসে দেখি, কত রকম পাখি ডেকে উঠছে। শরত কালে, চলে গেছি কালিন্দী কুঞ্জের পাশের কাশবনে, যেখানে মা দুর্গার বিসর্জন হতো। ওখানে খুঁজে পেতাম আমার আশৈশবের ইছামতীকে। যে নদী আমার ভেতর চাগিয়ে দিয়েছে গান, কবিতা।

শাহী দিল্লির লাহোরি গেট পেরিয়ে দরিয়াগঞ্জ, নয়ী সড়কে ঘোরাঘুরি করতাম পুরানো বইয়ের টানে। দেখা হতো দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক,  জে এন ইউ এর স্কলার, ফার্মাকোলজির প্রফেসরের সাথে। কি আশ্চর্য, তারা সবাই প্রায় বাঙালি ছিলেন! 

জে এন ইউ আমার জীবনে এক গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। আমার স্ত্রী যখন গবেষনার কাজে ব্যস্ত, তখন আমি জে এন ইউ এর প্রকৃতিকে আবিস্কার করতাম। আমার অনেক কবিতা এখানকার পাথুরে জমিতে বসে লেখা।

দিল্লি আমার ভেতর থেকে বার করে এনেছে অনেকটাই। এখানেই আমার গান গাওয়ার শুরু, পরিচিতি, নিজের গানের দল তৈরি করা, বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রিত হয়ে কবিতা পড়া, সাহিত্যের আসরে পরিচিত হওয়া এসব অনেক কিছু। দিল্লির কাছেই তো পেয়েছি কর্মক্ষেত্রে, শত প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে, সফল হওয়ার প্রেরণা। এখানেই তো পেয়েছি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু শ্রেষ্ঠ পাওয়া, যা কিনা আমার আজীবনের সঞ্চয়।

দিল্লি,  তুমিই আমায় আরো বাঙালি করেছ, প্রতিনিয়ত মনে করিয়েছ, ঠিক কোথায় লুকিয়ে আছে আমার প্রানভোমরা। এখানেই তো বারবার বাঙালিয়ানার অঙ্গীকারে আবদ্ধ করেছি নিজেকে। দিল্লি, তোমার ঋণ শোধ করি কিভাবে?


No comments

FACEBOOK COMMENT