DEHLIJ

রুবি কুণ্ডু

উপহার 

রুবি কুণ্ডু



"ওঠ্ ওঠ্.. কটা বাজে খেয়াল আছে? এক্ষুনি সবাই চলে আসবে। ওদিকে তোর বাবাও যেনো আর দিন পেলোনা ট্রেন মিস করার। বারবার বলেছিলাম মেয়েটার জন্য একটা দিন ছুটি নাও। কিরে? আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লি? ভগবান..আমার হয়েছে যত জ্বালা। "

"ওহ্ঃ মা,চেচাচ্ছ কেন?বাবা এসেছে?"  আদুরে গলায় প্রশ্ন করল নন্দিনী। 

"আরে বাবা, তোর বাবা এলে তো সমস্যা মিটেই যেত। সেই জন্যই তো তোকে ডাকছি। ওঠ না, মা আমার, ওই মোড়ের দোকান থেকে একটু মিষ্টি এনে দে। তোর বাবা ট্রেনটা মিস করেছে।"


"বাহ্, আমাকে আরেকটু আগে ডাকতে পারলে না! এখনো মিষ্টি আনব, তারপর রেডি হবো, কি করে হবে বলতো?......দাও..টাকা দাও।" 

" টেবিলের উপর রাখা আছে। চট করে আসবি, দেরি করবি না যেন।"

"হ্যা যাব আর আসবো।"


আকাশী রঙের চুড়িদারটা পরে জোর পায়ে হেঁটে দোকানে গেল নন্দিনী। বেশ ভিড় দোকানে। এখন কি হবে! বেশ খানিকটা দেরি হয়ে যাবে। ওদিকে    সবাই চলে আসার আগেই গিয়ে রেডি হতে হবে।  মিষ্টি কিনে তাড়াতাড়ি করে বেরোতে যাবে, এমন সময়... "কিরে কেমন আছিস?"


 খুব চেনা কিন্তু দীর্ঘদিনের না শোনা কণ্ঠস্বরে চমকে ফিরে তাকাল নন্দিনী। 


"আরে হাঁ হয়ে গেলি যে! মিষ্টির দোকানের মাছিগুলো যে এবার তোর মুখে ঢুকবে। চিনতে পারছিস না? "  অরেঞ্জ কালারের পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষটি প্রশ্ন করল নন্দিনীকে। 


"রূপম দা? তুমি?কেমন আছো? এদিকে তো আর আসোই না এখন আর। " 


" হ্যাঁ রে, সময় পাইনা একদম। আজ এদিকেই  নিমন্ত্রণ ছিল তাই... তোর খবর বল। পড়াশোনা কেমন চলছে? "


"ভালোই"


"চল্ ওই গাছ তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলি।এখানে বড্ড ভিড়।"


" চলো। "


"তারপর? কোন ইয়ার যেন? থার্ড ইয়ার, তাই না?" 


"হ্যাঁ। তুমি? চাকরি করছ?"


" হ্যাঁ। WBCS "


" তাই? তাহলে তো বিরাট ব্যাপার! দারুন মজা। খুব তাড়াতাড়ি তাহলে বিয়ের কার্ড পাবো?"


" ঠিক বলেছিস। মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। মোটামুটি সব ফাইনাল। প্রথমে তোদের বাড়িই আসবো, কাকিমাকে বলিস। হ্যাঁরে? কাকু কাকিমা কেমন আছে? "


"সবাই ভালো আছে।"


"আচ্ছা। তা বাড়িতে গেস্ট এসেছে নাকি? এত মিষ্টি?"


" আসলে আজ আমাকে পাত্রপক্ষের দেখতে আসার কথা। ছেলের মা বাবা আসবে আজকে।  তারপর পছন্দ হলে পরে আসবে ছেলে। "


" তাই? আগে বলবি তো! যা, যা, শুধু শুধু দেরি করিয়ে দিলাম। "


"তুমিও চলো না। মা তোমাকে দেখলে খুশি হবে।"


" দেখি ফেরার পথে পারলে যাব। মিষ্টিগুলো রাখিস  কিন্তু আমার জন্য। "


"তুমি এখনো মিষ্টি পাগল? আচ্ছা এসো কিন্তু। এই রে মা ফোন করেছে।" 


" ওরা মনে হয় চলে এসেছে।  যা এবার। " 


মিষ্টি হেসে চলে গেল রুপম। পিছু ডাকতে গিয়েও থেমে গেল নন্দিনী। কি লাভ ডেকে! কিছু স্মৃতি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে যাওয়াই ভাল। বাড়ির পথে পা বাড়ালো নন্দিনী। মনে পড়ে গেল ছয় বছর আগের কথা, যেদিন প্রথম বাবার সাথে রূপমদার কাছে গিয়েছিল। ও তখন ক্লাস নাইন। মনের 

প্রজাপতির ডানায় রং লাগতে শুরু করেছে একটু একটু করে। বাবা নিয়ে গিয়ে বলেছিল "রূপম এই হলো তোমার নতুন ছাত্রী নন্দিনী। ভালো করে গাইড কোরো। অংকে তেমন একটা পারদর্শী না।


" আপনি চিন্তা করবেন না, আমি বুঝে নেব।" হাসি মুখে বলেছিলে রূপমদা।


ভাড়া বাড়িতে থাকতো রূপম দা। দুটো রুম, একটাতে পড়াতো আর একটা বেডরুম। সামনের বারান্দায় ব্যাচেলার মানুষের রান্না।

সেই শুরু হল রূপমদার কাছে অংক পড়তে যাওয়া। তখন এমনই একটা বয়স যখন সব কিছুই রঙিন লাগতে শুরু করে চারপাশে। পড়তে গিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকত রূপমদার দিকে। কি সুন্দর দেখতে! অদ্ভুত টান অনুভব করতো নন্দিনী। এতদিনের বিভীষিকা অংক টা পর্যন্ত ভালো লাগতে শুরু করলো। অন্যান্য টিউশন দু-একদিন কামাই হলেও অংক ক্লাস ঠিক জয়েন করতো ও। সেটা অংকের টানে না রূপমদার আকর্ষণে পরিষ্কার বোঝা যেত না। 

আস্তে আস্তে এমন হলো উঠতে বসতে একটাই মুখ চোখে ভাসতো।আর সেই হাসি মুখটা মনে পড়লেই ঠোঁটের কোণে অজান্তেই ফুটে উঠত লাজুক হাসি। আয়নার সামনে বসে আনমনে ভাবতে ভাবতেই কেটে যেত ঘন্টাখানেক।


 সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল সকাল থেকেই। বিকেলের টিউশনে একমাত্র নন্দিনীই উপস্থিত ছিল। বাকিরা তখনও আসেনি, আসবে কিনা তাও সন্দেহ। রূপমদা পাশের ঘর থেকে জিজ্ঞাসা করেছিলো      " কিরে, আর কেউ এসেছে?"


 "না রূপমদা,আসবে কিনা তাও তো বুঝতে পারছি না।"


" আচ্ছা আর একটু বস। আমি দশ মিনিট পরে আসছি। "


"আচ্ছা। "


পড়ার ঘরটাতে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল  নন্দিনী। তারপর হঠাৎ মনের খেয়ালে মার্কার পেনটা তুলে নিয়ে হোয়াইট বোর্ডের এক কোণে একটা লাভ সাইন এঁকে ফেলেছিল। মাঝখানে যত্ন করে লিখেছিল R..... স্নায়ু অবশ হয়ে আসছিল। হঠাৎ মনে হলো এসব সে কি করছে, তাও রুপমদার বাড়িতে বসে! তাড়াতাড়ি করে R লেখাটা মুছে দিয়েছিল। লাভ সাইন টা মোছার আগেই বাইরে দুজনের পায়ের আওয়াজ পেয়েছিল। তড়িঘড়ি করে মার্কারটা রেখে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছিল সে।

দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলো অনিতা আর পলাশ। ওদের আওয়াজ পেয়ে রূপমদাও পাশের ঘর থেকে চলে এসেছিল। সহপাঠীদের চোখ এড়ালেও রূপম দা অংক করাতে গিয়ে ঠিক দেখে ফেলেছিল লাভ সাইন টা। ঘুরে দাঁড়িয়ে তিনজনের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করেছিল "কে করেছে এটা? " 


নন্দিনী মুখ নিচু করে ঢোক গিলছিলো। বর্ষার  ঠান্ডা ওয়েদারেও ঘাম ছুটছিল যেন! গাল ঠোঁট উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ফট্ করে নন্দিনীর মুখ দিয়ে মিথ্যেটা বেরিয়ে গিয়েছিল "ওটা আগে থেকেই ছিল রুপমদা। আমি এসেই দেখেছি। হয়তো আগের ব্যাচের কেউ... "


বোর্ড মুছতে মুছতে ভ্রু কুঁচকে, মুচকি হেসে রূপমদা  বলেছিল " ও আচ্ছা। ছেলেপিলেগুলো খুব পেকেছে অসময়ে। "


দীর্ঘশ্বাস ফেলে বোতল খুলে ঢকঢক জল খেয়ে নন্দিনী ভাবছিল, ভাগ্যিস R  টা মুছে ফেলেছিলাম! কিন্তু  রূপমদা, তুমি কি শুধু ম্যাথের সূত্রই বোঝ? মনের  সূত্র কি একটুও বোঝনা? খাতার  অংক গুলো পড়ো, কিন্তু যে লিখেছে তার মনের ভাষা পড়তে পারো না? আমি যে তোমায়....


" ঠিকই বলেছিস নন্দিনী। আগের ব্যাচেরই কারো  কাজ হবে।  অনিতা পলাশ এসব করবে না জানি। আর তুই তো একটা ভেবলি। তুই এসবের কি বুঝিস। এখনো পুতুল খেলিস।" বোর্ডে একটা পাটিগণিত লিখতে লিখতে বলেছিলো রুপমদা।

 

 আর সহ্য হয়নি নন্দিনীর। চোখ ফেটে জল এসেছিল অভিমানে। অশ্রুজল খাতার পাতায় পড়ার আগেই একছুটে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল সে " আমি বাড়ি যাচ্ছি রূপম দা। খুব পেট ব্যথা করছে।"


" আরে ছাতাটা তো নিয়ে যা!".....


ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে ঘরে দরজা দিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল নন্দিনী। কি ভাবে টা কি রুপমদা তাকে? সে কাউকে ভালবাসতে পারে না? একমাত্র বিছানার পাশবালিশ টাই জানত কিভাবে একের পর এক বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়েছে তাকে। কতদিন পাশবালিশটাকেই রূপমদা মনে করে বুকে জড়িয়ে রাখতো, কল্পনায় স্বাদ পেতে চাইতো স্পর্শসুখের।

 একদিন তো সকালে মা ওই ভাবে থাকতে দেখে বলেছিলো" কান্ড দেখো মেয়ের। এত বড় মেয়ে বাচ্চার মতন বালিশ জড়িয়ে আছে।ছাড় চিপসে গেল যে! " খুব লজ্জা পেয়েছিল সেদিন। আর সেদিন রাত থেকেই দরজায় ছিটকিনি দিয়ে ঘুমানো শুরু করেছিল।


 "কিরে? বাড়ি কোন দিকে?" মায়ের কন্ঠে স্মৃতির চমক ভাঙলো নন্দিনীর। দেখল ওর দেরি দেখে বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে ওর মা।স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে কখন যে বাড়ির কাছে চলে এসেছে সে বুঝতেই পারেনি। আর একটু হলেই বাড়ি ছাড়িয়ে যাচ্ছিল অন্যমনস্ক হয়ে। 


" এই তোর তাড়াতাড়ি ফেরা? "নন্দিনীর হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেট টা তাড়াতাড়ি নিয়ে নিল ওর মা। "চল্ চল্ ওরা এসে বসে আছে"


" কি! কখন আসলো! এখন কি হবে?"  উৎকণ্ঠায় চোখ ছানাবড়া নন্দিনীর। "ওদের সামনে দিয়ে  এভাবে ঢুকতে হবে আমাকে?" 


 "আর কি করা যাবে? সব কপাল। আমি বরং ওদের সাথে গল্প করছি।  তুই হুট করে একটা শাড়ি পড়ে নে, বেশি সাজার দরকার নেই। "  বারান্দায় উঠতে উঠতে বলল নন্দিনীর মা। 


নন্দিনীকে নিয়ে বারান্দা পেরিয়ে ডাইনিং -এ ঢুকলো ওর মা। হাসিমুখে পাত্রপক্ষকে বলল "একটু 10 মিনিট সময় দিন।আসলে ওর বাবা এখনো ফিরতে পারেনি তো,ট্রেন মিস করেছে। তাই ওকে  একটু দোকানে পাঠিয়ে ছিলাম আরকি।বুঝতেই তে পারছেন। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।"


নন্দিনী ওড়নার একটা কোনা আঙুলে নিয়ে জড়াতে জড়াতে মৃদুহাস্যে তাকাল পাত্রের মা বাবার দিকে।  ইস্ কি ভাবছে এরা! কেমন একটা ব্যাপার হয়ে গেল!


" এদিকে এসো" পাত্রের মা ডাকলেন নন্দিনীকে। থাক দিদি, ওকে আর এই গরমে শাড়ি পরতে হবে না। এমনিতেই ঘেমে গেছে। তুমি বরং আমার পাশে এসে পাখার নিচে বসো।"  

একথা শুনে অবাক হয়ে একবার মার দিকে তাকালো নন্দিনী। মায়ের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে দোটানায় পড়েছে। মা কিছু একটা ভেবে ইশারা করাতে, নন্দিনী ধীরে ধীরে গিয়ে সোফায় বসল।পাত্রের বাবা বললেন "আপনার মেয়েতো এমনিতেই সুন্দরী। আর যেভাবে লজ্জা পাচ্ছে  তাতে সৌন্দর্য্য আরও বেড়ে গিয়েছে। তুমি আরাম করে বোস মা। সংকোচের কিছু নেই। "


ইতিমধ্যেই নন্দিনীর বাবাও চলে এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বার্তা ও খাওয়া দাওয়ার পর, পাত্রের মা বাবা উঠে দাঁড়ালেন। জানিয়ে গেলেন নন্দিনীকে তাদের খুব পছন্দ।পরের সপ্তাহে পাত্র নিজে আসবে দেখতে। আর তাদের যখন পছন্দ হয়েছে ছেলেরও পছন্দ হবে। যাওয়ার সময় নন্দিনী ও তার বাবার ফোন নম্বর নিয়ে গেলেন। আর নন্দিনীর সাথে একটা সেলফিও নিলেন।


রাতের খাওয়ার পর্ব সেরে, নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় ছিটকিনি দিল নন্দিনী। জানলার পর্দা সরিয়ে দিতেই এক টুকরো দখিনা বাতাস এসে গন্ধরাজ ফুলের সুবাস মাখিয়ে দিয়ে গেল নন্দিনীর সারা গায়ে। আজ আর ঘুম আসছে না। বিকেলে দেখা রূপমদার মুখটা খুব মনে পড়ছে।তাড়াহুড়োতে ফোন নম্বরটা ও নেওয়া হলো না। আচ্ছা! ফেরার পথে যে আসবে বললো! কই এলো না তো!

 আসলে তারই ভুল। রূপম দা কখনোই তাঁকে ছাত্রী ছাড়া আর কিছু ভাবেনি। সেই বরং নিজে থেকে কত কিছু ভেবে গেছে হ্যাংলার মতো। 

নিজেকে বোঝাল নন্দিনী না আর তার কথা ভাববে না। সে এখন সে অন্য কারোর ঘরে যেতে চলেছে। তাই যে তার অনুভূতিটাকে কখনোই বুঝতে চাইনি, তার কথা সে আর কখনো ভাববে না। একসময় মনে খুব কষ্ট পেয়েছে সে,আর না। 

কিন্তু অবাধ্য মন কথা শোনে কই! যত্ন করে রাখা সেই মাধ্যমিকের ম্যাথ খাতাটা সে টেনে বের করল বুকশেলফের নিচের তাকটা থেকে। হাত বুলালো রুপমদার হাতের লেখায়। একসময় নন্দিনীকে দেখা যেত মাঝে মাঝেই বালিশের নিচে খাতাটা  রেখে ঘুমাতে। বাবা ভাবতো মেয়ের বুঝি অঙ্কের প্রতি ভীষণ ভালোবাসা জন্মিয়েছে। আসলে সে তখন এই খাতাটার মধ্যে রূপমদার বুকের আশ্রয়টা  কল্পনা করতো। 


হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপের নোটিফিকেশন এলো।একটা অচেনা নম্বর থেকে কেউ তাকে hi লিখে পাঠিয়েছে।ডিপিতে একটা হলুদ গোলাপের ছবি।  সে রিপ্লাই দিলো --আপনি কে? আর আমাকে কি দরকার? 

--আমি সুরজ। আজ আমার মা-বাবা আপনাকে দেখতে গিয়েছিল। সামনের সপ্তাহে আমার যাওয়ার কথা। কিন্তু তার মনে হয় দরকার হবেনা। কারণ মায়ের ফোনে তোলা ছবিতে আপনাকে দেখেছি, আমার ভীষণ ভালো লেগেছে আপনাকে। আর মা-বাবার তো খুবই পছন্দ আপনাকে। তাই আপাতত আর যাচ্ছি না। আপনারাই বরং আসুন একদিন। আর না হয় 2/3 সপ্তাহ পরে যাব বাবা মাকে নিয়েই। সেদিন আমাকে যদি আপনার পছন্দ হয় তাহলে ওই দিনই পাকা কথা হবে। ঠিক আছে?


 এরপর নন্দিনী আর ভেবে পেল না কি লেখা উচিত। আবার মেসেজ এলো --কি হলো ম্যাডাম? কিছু বলছেন না যে! চেনা নেই জানা নেই, হঠাৎ করে এত কিছু বলে ফেললাম বলে বিরক্ত হলেন? তাহলে সরি। 


নাহঃ এবার তো কিছু একটা লিখতেই হয়। নন্দিনী লিখলো---ঠিক আছে আসবেন।

---আচ্ছা গুড নাইট। পরে আবার কথা হবে। ---গুডনাইট।


 ফোনটা টেবিলে রেখে বালিশ নিয়ে উপুর শুয়ে পড়লো নন্দিনী। কেমন একটা যেন অস্বস্তি হচ্ছে। এই কি তার হবু স্বামী? এরপর যেদিন ওরা আসবে সেদিনই কি তাহলে তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে? চলে যেতে হবে মা-বাবাকে ছেড়ে? কেমন যেন চোখ দুটো ভারী হয়ে এল জলে। 


************


পরদিন বিকেলে নন্দিনী রেডি হচ্ছে তানিয়াদের বাড়ি যাবে বলে। এমন সময় আবার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ। সেই হলুদ গোলাপ। ---নন্দিনী, আপনার কাছে একটা কথা জানতে চাই। না মানে সকালে গুডমর্নিং লিখেছিলাম, এখনো কোন রিপ্লাই পেলাম না তো! তাই বলছি আর কি। আপনি কি অন্য কাউকে ভালোবাসেন? আমাকে বলতেই পারেন বন্ধু ভেবে। আপনি যদি আমার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড না হন তাহলে আমরা আর শুধু শুধু যাব না। যদি কাউকে ভালোবাসেন এবং কোন সমস্যা হয় বলুন আমি সাধ্যমত হেল্প করবো।


 এবার একটু বিরক্ত হয় নন্দিনী। ওদিকে তানিয়াও মেসেজ করেছে --তোর আর আসতে হবে না, আমি তোর বাড়ি যাচ্ছি। 

এমনিতেই তো বেরোতে দেরী হয়ে গিয়েছে, তার ওপর এখন যদি রিপ্লাই দিতে বসে, তাহলে তো আরো দেরী হয়ে যাবে। আর তানিয়া যে মেয়ে হয়তো দেরি দেখে সত্যিই বাড়িতে চলে আসবে, আর মাকে বলে দেবে আজকে ফুচকা খাওয়ার প্ল্যানের কথা। এমনিতেই মা এসব খেতে দেয় না!


ও লিখলো-- দেখুন, আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি। তাই রাতে মেসেজ করছি। আর আপনি যা ভাবছেন তেমন কোন কিছু নেই। 

মেসেজটা সেন্ড করেই মোবাইল ডাটা অফ করে দিলো। তাড়াতাড়ি হালকা লাল শেডের লিপিষ্টিকটা বুলিয়ে নিলো পাতলা ঠোটে। এমন সময় কলিংবেল বাজলো।হয়ে গেল আজকের ফুচকা খাওয়া! মা খোলার আগে বরং নিজেই গিয়ে খুলে দিক দরজাটা।

দরজার দিকে যেতে সে ভাবল, মুখটা চেপে ধরতে হবে আগে মুটকির। বেফাঁস কিছু বলে না ফেলে মার সামনে।  দরজা খোলার সাথে সাথে জোর একটা ধাক্কা খেলো নন্দিনী হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। সামনে দাঁড়িয়ে তানিয়া নয় রূপম দা! 


"সবসময় ভেবলির মতো হা করে দাঁড়িয়ে থাকিস কেন রে? ঢুকতে দে। কাকিমা? "

এই বলে ঘরের দিকে পা বাড়ালো রূপম।


ততক্ষণে নন্দিনীর মাও ডাইনিং এ চলে এসেছে।"ওমা কে? রূপম? বাবা কতদিন বাদে এলে। বসো বসো। তা বলো আছো কেমন?"


"ভালো আছি। শুভ নববর্ষ। " রূপম প্রণাম করলো নন্দিনীর মাকে। "আপনারা কেমন আছেন? " সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল রূপম। 

"এইতো বাবা, চলে যাচ্ছে। "

ততক্ষণে বাইরের দরজাটা বন্ধ করে নন্দিনী এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের মাঝে। সে দিকে চোখ পড়তেই রূপম জিজ্ঞেস করল "বাবাহ্ এত সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস?"


" তানিয়াদের বাড়ি। "


"তারপর? কালকে ইন্টারভিউ কেমন হলো? "


নন্দিনীর মা বলল "সে কি? তুমি কি করে জানলে পাত্রপক্ষ এসেছিল! "


অবাক হয়ে রূপম বলল "সেকি!ও কিছু বলেনি আপনাকে? কাল বিকেলে ওর সাথে দেখা হলো মিষ্টির দোকানে! "

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে বলল "কিরে? বলিস নিয়ে বাড়িতে? "


না, মানে, আসলে মাথায় ছিল না ব্যাপারটা এত কিছুর মধ্যে।  ইতিমধ্যে কলিং বেল বাজল। দরজা খুলে নন্দিনী দেখলো, বাবা অফিস থেকে এসেছে।"


"বাবা,রূপমদা এসেছে। "


"রুপম!.... ও...... আচ্ছা রুপম? কই চল্ তো,  চল দেখি।"


 অফিসের ব্যাগটা টেবিলে রেখে সোফায় বসল নন্দিনীর বাবা। 

"কেমন আছ? বহুদিন বাদে এলে।"


"আসলে এসেছি নিমন্ত্রণ করতে।" এই বলে একটা বিয়ের কার্ড টেবিলে রাখলো রূপম।

" তাই নাকি? বাহঃ এতো খুব ভালো খবর " স্ত্রীকে বললেন "কিগো, যাও চা মিষ্টি নিয়ে এসো! আজ নববর্ষ বলে কথা!"


"হ্যাঁ যাই।" রান্নাঘরে গেল নন্দিনীর মা।


" আমিও যাচ্ছি, চলো।"


 "না তুই বোস্। কথা বল। কতদিন পরে এলো!"


রূপম হাসিমুখে  বলল "সামনের সোমবার আমাদের বাড়িতে আপনাদের নিমন্ত্রণ। অবশ্যই আশা চাই। " নন্দিনীকে বললো "আসবি কিন্তু।"


 বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল নন্দিনীর।যন্ত্রণা, এমন একটা জিনিস হারানোর যন্ত্রণা যেটা কোনোকালেই তার অধিকারে ছিল না। একটা মন কেমনের অনুভূতি দলা পাকিয়ে উঠছে হৃদয়ের কোণে। হাসি মুখে রূপমদাকে অভিনন্দন জানাতে চেয়েও সে পারছে না। 


নন্দিনীর বাবা বলল "তোমার তো ছেলে হিসেবে কোন তুলনাই হয় না। যে মেয়ে তোমার স্ত্রী হবে সে নিঃসন্দেহে সুখী হবে। কাল নন্দিনীকে যে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল শুনেছি সেই ছেলেটিও ভালো। প্রতিষ্ঠিত পারিবারিক ব্যবসা আছে ওদের । কম্পিউটার বিজনেস। আর  আচার-আচরণ বিনম্র তোমারই মতন। "


"বাহ, তাহলে তো ভালো ই। আশা করি নন্দিনী  সুখী হবে।"


"তোমরা বসো। আমি একটু তানিয়াকে কল করে আসছি। আসলে আমাদের বেড়ানোর কথা ছিল তো তাই।" এই বলে নন্দিনী উঠে গেল, আর ঘরে যাওয়ার সময় তার রূপমদার বিয়ের কার্ডটা নিয়ে গেল।তারও তো জানতে ইচ্ছে করছে, কে সেই সৌভাগ্যবতী! কি তার পরিচয়!


 ডাইনিং রুমের নন্দিনীর বাবা-মা আর রুপম বসে গল্প করছে।নন্দিনী তার ঘরে এসে কার্ডটা নিয়ে খাটের পাশে রাখার চেয়ারটিতে বসলো। বাহঃ ভারী সুন্দর খাম তো! দেখে মনে হচ্ছে কলাপাতা গোটানো ক্যালেন্ডারের মত করে। এমনও হয়? অবশ্য আজকাল কতটা ডিজাইনই তো হচ্ছে। কিন্তু একি! ভিতরের কার্ড কোথায়? এ যে একটা স্যাম্পেল কার্ড!  আর একটা কাগজ ভাঁজ করা। খুলে দেখল একটা চিঠি। রূপমদার হাতের লেখা।........


প্রিয় নন্দিনী, 

              খুব অবাক হয়ে গেলি না খামটা খুলে? আজ তোকে কিছু বলতে চাই। আমি যতদূর খোঁজ নিয়েছি তুই এখনো সিঙ্গেল।জানিনা বর্তমানে তুই মনে মনে কাউকে ভালবাসিস কিনা? তবে আগে যে আমাকে ভালবাসতিস সেটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি?।তুই হয়তো ভাবতিস আমি কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি বেশ টের পেতাম তোর মনের অনুভূতি গুলো। কিন্তু তাতে সারা দিইনি তোর পড়াশোনার কথা ভেবে। আর আমিও তো বেকার ছিলাম। 

সেদিন আমার ঘর থেকে আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম বোর্ডে তুই খুব যত্ন করে R লিখছিস।কিন্তু তোকে ধরা দিইনি।তুই লজ্জা পাবি ভেবে। 

         আর লাস্ট বার যখন কাকু কাকিমাকে বিজয়ার প্রণাম করতে এলাম সেদিনের ঘটনার স্পষ্ট মনে আছে। অনেক মিষ্টি দিয়েছিল কাকিমা সেদিন। আমার একটা আধখাওয়া সন্দেশ প্লেটে পড়েছিল। ভুল করে ফেলে যাওয়া রুমালটা নিতে যখন ফেরত আসলাম, দেখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লাজুক মুখে আমার এঁটো সন্দেশটা তুই খাচ্ছিস। যে কারো বোতল থেকে জল খেতে চায়না সেই নন্দিনী খাচ্ছিলো আমার এঁটো! বুঝেছিলাম জল গড়িয়েছে অনেক দূর। এছাড়াও অনেক কিছুই মনে আছে। তুই হয়তো তখন আমার প্রেমে পাগল। খুব ভালোবাসতিস না আমাকে? 

আমিও তোকে খুব ভালোবাসি খুব। আগলে রাখতে চাই নিজের বুকে।  তাই কাল আমার বাবা-মাকে পাঠিয়েছিলাম তোদের বাড়ি।আমিই সুরজ। আমার ঠাকুমার দেওয়া নাম, তুই জানতিস না। তোর বাবা মাও জানে। মা কাল বলেছে সবটা। আমরা সবাই মিলে আসলে তোকে সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলাম। 

    তুই যদি আজও আমায় ভালবাসিস তাহলে আজ আমি বাড়ি যাওয়ার আগেই উত্তরটা দিবি। আর তোর উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আজও আমার প্লেটে একটা সন্দেশ থাকবে। সেটা তোর ঘরে একসাথে খেতে চাই। রাজী?


                                                                          ইতি

                                                                             --- তোর রূপমদা।


চিঠিটা পড়ার পর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে নন্দিনীর। হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে জলের বোতলটা তুলে নিল। ও যা পরলো তা কি সত্যি? আর ওর বাবা-মা এত ভালো অভিনয় জানে? একবারও বুঝতে দিল না কাল থেকে?


 আনন্দে উত্তাল হচ্ছে হৃদয় সমুদ্র। মনে হচ্ছে সব কিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সুখের জোয়ারে। এত খুশিও ভগবান তুলে রেখেছিল ওর জন্য! অবিশ্বাস্য!  এ যে হারানো মানিক ফিরে পাওয়া।


 আস্তে আস্তে উঠে ডাইনিং এর দরজা দিয়ে উঁকি মেরে তাকালো সে অতি সন্তর্পনে। ইস্ যাহঃ,ঠিক দেখে ফেলল রূপম দা। ওকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে সে। নন্দিনী ও মুক্ত ঝরা হাসি উপহার দিয়ে কালবৈশাখীর বেগে বিছানায় এসে মুখ লুকালো।


খানিক পরে হঠাৎ ওর পিছন দিকে দরজায় গলা ঝাড়ার শব্দ। রূপমদার গলা পেয়ে হার্টবিট বেড়ে গেলে এক মুহূর্তে। ইস্, কি লজ্জা লাগছে তার। কি করে মুখোমুখি হবে! তাহলে সব জানতো রূপম দা?

 শরীর অবসন্ন লাগছে অস্থির লাগছে। নিজের হার্টবিট নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে। 

"এসে বিছানায় শুয়ে পড়লি যে। পেট ব্যথা বুঝি?"

রূপম জিজ্ঞেস করলো।


ইস লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। ফর্সা গাল গুলো ডালিমের মতো রাঙা হয়ে গেছে। কোন রকমে বিছানা থেকে উঠে বলল "বোসো"


"কাকে বসতে বলছিস? বুঝতে পারছি না তো!"


"তোমাকে "

মুখ নিচু করে উত্তর দিলো নন্দিনী। 


"তাহলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল।"


 এবার কি করে তাকাবে সে! হঠাৎ এক হাতে তার হাতটা ধরে হ্যাচকা টান দিলো রুপম। ছিটকে এসে পরলো নন্দিনী রূপমের বুকের কাছে। রূপমের আর এক হাতে একটা প্লেট, তাতে একটাই সন্দেশ। নন্দিনীর কানে কানে ফিসফিস করে বলে উঠলো   " কি? সন্দেশ খেতে হবে তো?"


 হাত পাতলো নন্দিনী "দাও। "


নিজের ঠোট দিয়ে সন্দেশটা চেপে রেখে,প্লেটটা টেবিলে রেখে অস্পষ্ট স্বরে বলল রুপম "এখান থেকে খেতে হবে, এঁটো করে। "


নন্দিনী লজ্জায় মুখ গুঁজে রইলো রূপমের  বুকে। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুপম নন্দিনীকে। "আমিও তাহলে ছারছি না।"


"আচ্ছা বেশ, দাও।"এই বলে যেই না নন্দিনী সন্দেশটা কামড়াতে গেল, অমনি  রুপম চট করে একটা গভীর চুম্বন এঁকে দিলো নন্দিনীর ঠোঁটে।


" ইস্ এটা কি হলো? "


নন্দিনীকে বুকে জড়িয়ে রূপম বললো " এটা নববর্ষের উপহার " ।


No comments

FACEBOOK COMMENT