DEHLIJ

সেলিম মণ্ডল

বইপাড়া একটা চক্রব্যূহ

সেলিম মণ্ডল



বইপাড়া একটা চক্রব্যূহ। একবার যে ঢুকে যায়, বেরোতে পারে না। কত লোক এই বইপাড়ায় ঢুকে নিজের গন্তব্য ভুলে গেছে ঠিক নেই। যারা এসেছে তাদের কাছে একটাই ঠিকানা বইপাড়া। ঠা ঠা রোদ্দুর। গা ভিজে জবজব করছে। ঠিকানা কোথায়? বইপাড়া! টুপটাপ বৃষ্টি। ছাতা পর্যন্ত কাছে নেই। ঠিকানা কোথায়? বইপাড়া! পেটে সেভাবে কিছু পড়েনি। ঠিকানা কোথায়? বইপাড়া! এ-এমন এক চক্রব্যূহ কেউ ঢুকলে কিছুতেই বেরোতে পারে না। ধ্যান-জ্ঞান সব হয়ে ওঠে বইপাড়া। দূর থেকে আগত মানুষটিও ভুলে যায়, ফেরার কথা। কেউ কেউ শেষ ট্রেন না-পেয়ে বন্ধুর মেসে থেকে যায়।


বইপাড়ায় সবাই লেখক হতে আসে এমন না, কিন্তু অনেকেই আবার জানে না তারা কেন আসে। এ এক জটিল ধাঁধা। এ ধাঁধার সমাধান নেই। শুধুই বিস্তার আর তার ডালপালা।

কেউ ফতুয়া পরে আসে। কেউ টি শার্ট। কেউ-বা ঢিলেঢালা জামা। সবাই কি উদাসীন? একদম না। তবে এই পাড়ায় যে ঢুকে গেছে তার বুকে যেন গজিয়েছে নতুন ঘাসফুল। সে তার নিজের ফুলের গন্ধ শোকে। জল দেয়। মাঝেমাঝে তার সহবন্ধুদের বুকেও তাকায়। বুকই একমাত্র সম্ভাবনাস্থল। যেখানে বল রাখে। কখনো কখনো নিজেই গড়িয়ে দেয়। পিছু পিছু ছোটে। আবার ঘাসের ওপর বসে দেখে নেয় আকাশ। নিরবিচ্ছিন্ন আকাশ।

কিছুদিন আগে, এক বিয়ে বাড়ি থেকে ফেরার পথে, দেখি— অটোওয়ালা ও এক প্যাসেঞ্জারের মধ্যে কথা চলছে। বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। দু-জনেই বামপন্থী। কথায় কথায় তাঁরা একটি কথা বলছিলেন— কত লোককে দেখলাম পার্টি অফিসে বসে বিড়ি আর চা খেতে খেতে একটা জীবন শেষ করে ফেলল। না করল সংসার। না পার্টি কিছু দিল। পার্টি যদি লোকগুলোর কথা ভাবত, আজ এই অবস্থা হত না।

এই কথাগুলো ভীষণ স্ট্রাইক করল আমাকে। সত্যিই তো, বইপাড়া তার অন্যথায় কী! এই নেশার টানেই কতজন সংসার করল না। বইপাড়াই-বা তাঁদের কী দিল? বইপাড়া কি পারত না কিছুই দিতে? তাঁরা কি আর পরবর্তী প্রজন্মকে বলবে— যা, বইপাড়ায় যা?

হয়ত বলবে না। কিন্তু আবার একদল নতুন ছেলেমেয়ে আসবে। তারাও ঠিক তাদের পাশে বসে দু-চার কাপ লিকার চা অর্ডার করবে। কখনো কখনো মশলামাখা মুড়ি। একেকদিন পুরোনোরাই মিটিয়ে দেবে বিল। কালো লিকার চায়ের সাদা ধোঁয়ার মতো পেকে যাকে অনেকের চুল। নিজের ভার বইতে না পেরে কেউ কেউ নিত্যদিনের মতো ছুড়ে ফেলবে সমস্ত বাজার!

উই-এ খাওয়া বই দেখিয়ে, কেউ কেউ নিজের দিকে তাকিয়ে আপনমনে হাসবে। তার হাসি থামবে না। উইপোকা চলে যাবে, তবুও... কেটে দেওয়া বইয়ে আবার হাত বোলাবে। দুষ্প্রাপ্য বই বলে কিনে নিয়ে যাবে আরেকদল তরুণ, তারাও কী করে যেন ঢুকে গেছে এই পাড়ায়! বইয়ের ওপর বই সাজিয়ে রাখে। কলেজের বই। চাকরির বই। তার ওপর উইকাটা বই। সে গভীর আনন্দে থাকে। কম দামে পুরোনো বই পাওয়ার আনন্দ। সে বুঝতেই পারে না, এই উইপোকা শুধু বই কাটে না। কাটে সুতো। জীবনের সুতো। সমস্ত মাজনা দেওয়া সুতো। কিছুক্ষণ উড়তে থাকে ঘুড়ি। এই আনন্দটুকু বইপাড়া নীল আকাশ! এই আনন্দটুকু বইপাড়ার শরতের পেঁজা পেঁজা তুলোর মেঘ। সম্বৎসর শারদীয়ার আমেজ। 

No comments

FACEBOOK COMMENT