সম্পাদকীয়
সম্পাদকীয়
এভাবেই অনেকদিন কাটানো গেলো । কেটে গেছে প্রায় করোনা পরিস্থিতি । নিউ-নরম্যাল । আপনার আমার মধ্যে অনেকটাই দূরত্ব বেড়েছে । আপনি এখন অনেক পরিণত । কোথাও কোথাও সামান্য আবহাওয়ার পরিবর্তন নিয়ে দেহলিজ প্রায় চলে এলো ।
দেহলিজ, একটু দেরীতে এলো, তবে দূরস্ত এলো । নৈকট্য নিয়ে যার তেমন অহংকার নেই । মুকুলে ও পাখনায় কেটে ফেলা হয়েছে উদ্যান । নিকানো হয়েছে উঠান । বঙ্গভূমির আর একটি টগর আর মাতৃভাষার আর একটি অমলতাস নিয়ে সেজে উঠেছে রাজধানী ।
সম্পাদকীয় লেখা হবে, সেই রকম কথা ছিলো না । বরং একটা পুরানো সম্পাদকীয় পড়ে নেওয়া যাক ।
দেহ্লিজের দশম সংখ্যা প্রকাশ হলো । যতটা না ছিলো গুটি গুটি পা, নিন্দুকের চোখে বন্দুক রেখে ততটাই রুখে দাঁড়ায় বারুদবরণ আরবল্লি রিজ । ওখানে গ্রীষ্ম, ওখানে বর্ষা । ওখানে সাতচল্লিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড । তবুও পত্রে পত্রে সবুজের প্রজ্বলিত আভা, কণ্টকময় বৃক্ষের রুক্ষ প্রশাখায় নীড় বাঁধে তবুও বিহঙ্গ - সযত্নে ডিম পাড়ে , যারা নিজেরাই কোন একসময় ঘুমন্ত ছিলো উক্ত ডিমের ভিতরে । অভিভাবকহীন বেড়ে ওঠা এই সাহিত্যপত্র । মালিকানাহীন বঞ্জর পানিপথে যখন যমুনা ছুটেছে একলা, কোন আফগানী শেরশাহ এইসব বৃক্ষের গায়ে এঁকে দিলেন শিলমোহর । গ্র্যাডিয়েন্ট বরাবর ক্রমশ ছুটে যাওয়া সমগ্র মুঘল বাহিনী, ধুলোয় ভরে ওঠা মেহরাম-নগর । অস্পষ্ট হয়ে আসে দিল্লির শতাব্দী পুরানো খাপ । চারিদিকে আকাশচুম্বী বাড়ি, ব্যস্ত সড়কে বেড়ে ওঠা গতিবেগের প্রতিযোগিতা, জমি দখলের লড়াই । এর ভিতর জন্ম নিলো দেহ্লিজ, যার নিজস্ব শরীর দিয়ে তৈরি নিজেরই তোরণ, যার নিজস্ব গতি দিয়ে সামান্য এই সাহিত্য যাত্রা । যে কেউ আরোহী এর হতে পারেন, যে কেও সারথী । এই পুরানো ইটের চাতাল, এই রুক্ষ প্রেমের বুদ্ধ-জয়ন্তী পার্ক, আবহাওয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে দেহ্লিজের সহবস্থান । যে কেউ হতে পারেন দেহ্লিজ । দেহ্লিজ মানে সারভাইভ্যাল, ভৌগলিক চেতনার অভিপ্রকাশ, দেহ্লিজ মানে সবুজের হাতছানি, মুহূর্তযাপনের নাগরিক চিত্রকল্প, র্যাটরেসের প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে বেরোনো ব্যাঘ্র শাবক ।
দিল্লির সাহিত্য জগত বলে নানান বিভ্রান্তি আছে । দিল্লির বাংলা সাহিত্য নিয়ে আরো বিভ্রান্তি । সাহিত্যে ভাষার এটাচ করা যায় না । নাকি যায় ? সাহিত্যে শহরও এটাচ করা যায় না । নাকি যায় ? কত কিছুই তো করা যায় না । কেউ কেউ বলছে যায় । খাণ্ডবদাহে যখন পুড়ে যাওয়া জঙ্গল একটা বিশ্বাস মাত্র । ইন্দ্রপ্রস্থ একটা বিশ্বাস । কি বলছেন , বিশ্বাস তো । সেই রকম বিন্দু বিন্দু রেখা একটা বিশ্বাস, দ্রাঘিমা একটা বিশ্বাস । সময় ? সময় তো একটা বিশ্বাস !
যে কোন শহরের এই চরিত্র হতে পারে । গ্রাম কেটে শহরে পাড়ি দেন জনপ্রবাহ । শহরের নিজের কোন নন্দন-তত্ব থাকে না । আপাত দৃষ্টিতে, তার কোন ব্যথা, দুঃখ, বিষাদ নেই । তার চোখে এক উদাসীনতা, তার অধরে এক ধুসর জগতের শুষ্কতা , যার চোখের পাতায় পাতায় এক ক্রমবিকাশের রক্তক্ষরন । তার কান্না নাই । আগুনে ঝলসে ওঠে লাল কোট, পানিপথের বুকে দ্রুত শুকোতে থাকা যমুনা , কোন সম্রাট জাহাঙ্গীর বুঝি তার বজরা নিয়ে পৌঁছাবেন না কালিন্দিকুঞ্জের ঘাটে । আগুন নিয়ে খেলতে থাকেন আজকের শিশু, আবহাওয়ায় জ্বলতে থাকে দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস । দিল্লির পথে পথে পড়ে আছে সেই ইতিহাস চিহ্ন, রাজঘাটে সমাধি হয়ে জ্বলতে থাকেন মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী ।
কি গল্প হবে ? কাহিনীর বিপরীতে চাইতো এক খলনায়ক । যার অভিঘাতে রাখা হবে একটি তরমুজ কাটার আখ্যান । সর্বহারার সার্বভৌমতা । কোমল ভাবে মিশিয়ে দেওয়া হবে কড়ি, শৈশবের অপূর্ণ অভিলাষ, কৈশোরের প্রেম নিবেদনের ব্যর্থতা, যৌবনের বাংলা , মধ্যমেধার বাঙ্গালি ও বিষয় বিবেচনায় সমাজসেবা । হায় ! সেই রামও নাই , সেই রাবণ ও । ইংরাজ বিদায় নিয়েছে, তাই সেই স্লোগানও আর নাই । হায় থ্যানোস - কি লিখি তোমায় ? গ্যালাক্সির অর্ধ জনসংখ্যার আচমকা হ্রাস কোন কাব্যরস হতে পারে না । কোন রূপ রস গন্ধ হতে পারে না । কাব্যকথার জন্য যা চরমভাবে প্রয়োজনীয় । যদি ধরা হয়, আর ২৮ কোটি বাঙালি, অর্ধ জনসংখ্যা ১৪ কোটি । যাদেরকে আমরা ধরে নিতে পারি যে, তাদের কাছে একটি স্মার্ট ফোন আছে । মানে, প্রত্যেকের কাছে একটি একটি ফেসবুক অ্যাপলিকেশন রয়েছে । এইমতো অবস্থায়, প্রত্যেক ফোনের মালিক হবেন একজন বাংলা সাহিত্যের পাঠক । এবং সে একটি গল্প চায় ।
এইভাবে দেহ্লিজে গল্প ফিরে আসে । দেহ্লিজ একটি ওয়েব ম্যাগাজিন । ওয়েব পালটে ফেলছে জালবপনের সীমানা । ক্রিয়েটিভ লেখনীর ভৌগলিক চরিত্র মাল্টিপ্লাই করছে ভাইরাসের গতিতে । দেহ্লিজ সেখানে চাইছে, নিজস্ব পরিচয় । নিজের রক্তের ভিতর ঘুরতে থাকা এক বিশ্ব । নিজের আবর্তনে বুঝে নিতে চায় অস্তিত্ব । যেভাবে দিল্লি ফিরে আসে গল্পে । সহস্রবছরের দিল্লি, খাণ্ডবদাহের আগুনখেলা, ময়দানবের ইন্দ্রপ্রস্থ, অনঙ্গপালের লাল-কোট, চৌহান রাজের রাই কিলা পিথোরা । ইলতুতমিসের কুতুবমিনার । শূন্যকালের পরে যদিও কোন কাল থাকে না । গল্প তো এক প্রবহমান । না আশীর্বাদ, না অভিশাপ । মহানগরীর চরিত্রে এক নাটক বদল । দেহ্লিজ স্ট্যান্স নেয় সেই ব্যস্ত বাজারে । রাজপথে ওলা, উবের, সি এন জি অটোদের ভিড় । প্রেস কর্নারে চুটিয়ে চলছে রাজধানীর রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডা , দিল্লি হাটে বিদেশী পসরার বিকিকিনি । দিল্লি হাটার্সদের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছে তরুণ প্রজন্মের দেহ্লিজ ।
দিল্লি এক অদ্ভুত শহর । লাল কিলার পাথর ছুঁয়ে দেখি - এক ইতিহাসের মর্মরধ্বনি । দিল্লির সেই গল্পের কোন ঘাটতি নেই । দেহ্লিজের কাছে তার এই প্রার্থনা , দিল্লির নিজস্ব চরিত্র, রূপ, রং, পান, পিক, দেওয়াল, অট্টালিকা এই হোক তার সাহিত্য অনুষঙ্গ । যে রক্ত এতদিন ধুয়েছে গঙ্গা অববাহিকার বিন্দু জল, তাতে মিশে যাক যমুনার কালো । যাকে আমরা মঞ্জিল বলে মানিনি, যাকে আমরা ভাগ্য বলে গ্রহণ করিনি, অথচ খাদ্য বস্ত্রের সন্ধানে মাইগ্রেশন করে আমাদের পার করে আসতে হয়েছে শোন, সরযূ ফল্গু । এই এত দূর, দিল্লি দিলওয়ালোঁ কা শেহ্র । আমাদের রক্তে ক্রমশ প্রবেশ করছে - সারভাইভাল, আমাদের রক্তে মিশে যাচ্ছে বিজাতীয় জাতীয়তাবোধ । মননে, চিন্তনে রং ধরেছে দিল্লির ধূসরতা, চেতনায় ফুটে উঠেছে ইন্দ্রপ্রস্থের সবুজ । দেহ্লিজ চায় তাদের একাত্ম করতে । যে কোন পরবাসে অবশ্যম্ভাবী দেওয়াললিখনকে গ্রহণ করার নাম ভাগ্য, আর তাকে ভালোবাসে আপন করে নেওয়ার নাম দেহ্লিজ । সাহিত্য ধারনার এই ভঙ্গুর কিনারায় বসে আমরা দেখতে চাই তার ঐতিহাসিক উত্তরণ ।
দিল্লির নিজ সাহিত্যভূমির বাংলা লেখক, কুমুদি অর্থাত জয়ন্তী অধিকারী এই করোনাকালে গত হয়েছেন । তার একটি অপ্রকাশিত রচনা সংগ্রহ করা হলো । লেখাটি একই ভাবে রাখা হলো দেহলিজে । আগামী সপ্তাহে প্রকাশ করা হবে দেহলিজ-১০ । আরো কিছু লেখক সূচী প্রকাশ করা হবে কাল । যারা দেহলিজের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেছেন, নিয়মিত পাঠ করছেন , তাদের প্রতি ভালোবাসা ও প্রতিশ্রদ্ধা । দেহলিজ পড়ুন । মেন পেজঃ https://dehlij.blogspot.com
পীযূষকান্তি বিশ্বাস
সম্পাদক
দেহলিজ পত্রিকা
নতুন দিল্লি, ভারত
যোগাযোগঃ poet.area@gmail.com
ওয়েব সাইটঃ https://www.ipatrika.com
ভালোই লিখেছিস।
ReplyDelete