DEHLIJ

ফরিদ ছিফাতুল্লাহ

জহির হাসানের সাথে উৎপল পাঠ 

ফরিদ ছিফাতুল্লাহ 



জহির হাসান না আঞ্চলিক না প্রমিত এক স্বসৃষ্ট ভাষায় উৎপলকাহন ফেঁদে বসে আছেন তাঁর বইয়ে। বইটির নাম ‘বিম্ব যেটুকু দেখায় উৎপল কুমার বসুর কবিতাঃলৌকিক মায়ার আঁতুড়ঘর ও গূঢ় সংকেতলিপি যত’ ।  তাঁর এই ভাষারীতিতে দেখা যাচ্ছে  সাধু বাংলা, বাংলার নোয়াখালী আঞ্চলিকতা, ঢাকাইয়া আঞ্চলিকতা ইত্যাদির মিশ্রণ আছে। অথচ জহির হাসানের জন্ম যশোর জেলায়। বোঝাই যাচ্ছে সুচিন্তিতভাবেই জহির এই ভাষাশৈলী তৈরিতে প্রয়াসী হয়েছেন। এই ভাষাটা বোধ করি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কথ্য ভাষাও নয়। সন্দীপনের কাছে লেখা উৎপল কুমার বসুর চিঠি খানায় যে নতুন ভাষা নির্মাণের আহবান পাওয়া যায় জহির বুঝি সেই আহবান-তাড়িত হয়েই নতুন ভাষার সন্ধান করছেন। 'বিম্ব যেটুকু দেখায়' বইটি বয়ান ও বয়নে সেই ইশারার সাক্ষ্য বহন করছে। আরো কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক- 

“তার স্মৃতিসত্তা ফেলি আসা দিনহাটার সামান্য মানুষদের জীবনের সাথে লবণ-পানির মতো মিশি আছে।“ 

“ অতীতের আচ্ছন্নতা নয় ইহা, বরং সেই জগতের লগে তার একটা যোগাযোগ তৈয়ার করবার চাইতেন কবিতায়”

“জীবনানন্দ দাশকে উৎপল নিছিলেন তার কবিতায়। কেউ কেউ জীবনানন্দের গন্ধ পান উৎপলে। কবিতায় উৎপলিক এভিনিউ চলি গেছে জীবনানন্দের ঘরের ভিতর দিয়া বটে”   


উৎপল কুমার বসু বাংলা কবিতার এক স্বতন্ত্র উদ্ভাসিত নাম। ষাটের দশকের কবি উৎপলের কবিতার সাথে পরিচয় নাই এমন কবিতা-পাঠক দুই বাংলায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।  জীবনানন্দের প্রবল অনুসারী হয়েও বাংলা কবিতায় উৎপলীয় এক নতুন রাস্তা সৃষ্টি করে বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন তিনি।  ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত তাঁর 'পুরী সিরিজ' কবিতার চটি বইখানি তরুণ কবিতাকর্মীদের মাঝে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। শোনা যায় "তাঁর এই চটি সাইজের ছোটো কবিতা পুস্তিকাখানি পুরাকালে তরুণ কবিরা মাথার কাছে রাইখে ঘুমাইত!" 

পুরী সিরিজের পর দীর্ঘ ১০/১২ বছরের বিরতির পর ১৯৭৮ সালে উৎপল কুমার বসুর 'আবার পুরী সিরিজ' প্রকাশিত হয়। পুরী সিরিজের মতোই আবার পুরী সিরিজও পাঠক-নন্দিত হয়। 


বাংলা কবিতার ইতিহাসের এমন এক কালখণ্ডে উৎপলের আবির্ভাব যখন একদিকে বাংলা কবিতার মূল স্রোতে জীবনানন্দের ঢেউ প্রবলভাবে ব্যাপ্তমান অন্যদিকে কবিদের মধ্যে এই ঢেউয়ের বাইরে বেরুবার প্রবল তাড়না । শক্তি-সুনীল, বিনয় এক বাংলায়, শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ অপর বাংলায় তেজ ছড়াচ্ছিলেন। এই রকম এক সময়ে স্বতন্ত্র এক কবিতা শৈলী নির্মাণ সহজ কাজ ছিলো না। কিন্তু অবলীলায় সেই দুঃসাধ্য কাজটি করে গেছেন উৎপল কুমার বসু।  অবলীলায় বলছি এই কারণ - উৎপল নিজে সাক্ষাৎকারে বলেছেন- তিনি কোন চাপ বা দায় অনুভবই করতেন না কবিতা লেখার। ভ্রমণ- আড্ডা ইত্যাদির মাধ্যমে জীবন উপভোগ করাই ছিলো তার মূল উদ্দেশ্য। এর ফাঁকে ফাঁকে লিখতেন কবিতা। 


কবি উৎপল কুমার বসুর সাথে আমাদের বিশিষ্ট নন্দনতাত্ত্বিক জহির হাসানের প্রথমে লেখাসূত্রে পরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বন্ধুতার সূত্রে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলো। কবিতার বিমুগ্ধ পাঠক যখন কবিকে  হাতের নাগালে পান তখন যত রকমের কৌতুহল থাকে পাঠকের মনে তার প্রায় সকলি মেটাবার চেষ্টা করেছেন জহির হাসান উৎপল বসুর সান্নিধ্যে। আর সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন নিজের পাঠকের উদ্দেশ্যে এমন এক বৈঠকি ভাষায় যা পড়ার সময় মনেই হয় না আনুষ্ঠানিক কোন বই পঠিত হইতেছে। বরং মনে হয় উৎপলের এক সাহাবীর সাথে উৎপলের তাবেয়ীনদের এক বৈঠকি আড্ডা চলছে।


২০০৬ সালে কবি উৎপল কুমার বসু বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন জাতীয় কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণে। ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলা চলাকালীন সেই কয়েকটা দিন জহির হাসান ছায়ার মতো উৎপলের সঙ্গী হয়েছিলেন। কাঁটাবনের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমির ৩০৪ নম্বর কক্ষ,  নিউমার্কেট যাওয়া, জামদানী শাড়ি কেনা, কবির পূর্ব পুরুষের ভিটা বিক্রমপুরের মালখানগরে যাওয়া সকল সময় জহির হাসান এবং মাঝে মাঝে জহির হাসানের স্ত্রীর বড়ো ভাই অধ্যাপক জাহিদ হাসান মাহমুদ সাথে ছিলেন। জহির হাসান কী এক অজ্ঞাত কারণে জাহিদ হাসান মাহমুদকে   “অধ্যাপক জাহিদ হাসান মাহমুদ' কিম্বা 'জাহিদ ভাই' না বলে 'স্ত্রীর বড়ো ভাই' হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। সে কথা থাক।  

বাংলাদেশ ভ্রমণকালে উৎপলের সাথে জহির হাসানের যে আলাপচারিতা তা 'বিম্ব যেটুকু দেখায় উৎপল কুমার বসুর কবিতাঃ লৌকিক মায়ার আঁতুড়ঘর ও গূঢ় সংকেতলিপি যত" বইয়ের বিশেষ এক অংশ। বইটি উৎপল কুমার বসুর পাঠকদের জন্য অবশ্য-পাঠ্য বলে মনে করি । জহির হাসান তাঁর বইটিতে উৎপলের  কবিতার এমন দিগন্ত বিস্তারী এবং মনোগ্রাহী আলোচনা করেছেন যে কবিতা বিষয়ক আলোচনা সাহিত্যে তা অনন্য সংযোজন।  যদিও তিনি বইটির শুরুতে কৈফিয়ত দিয়ে রেখেছেন - "গ্রন্থভুক্ত উৎপলের কবিতার উপর আমার লিখাগুলির ভিতর অনুভূতির প্রাধান্য বেশি, প্রজ্ঞার অভাব ও দুর্বল বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান স্পষ্ট।" গ্রন্থটি পাঠ শেষে যে কারো মনে হবে 'প্রজ্ঞার অভাব ও দুর্বল বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান'-  নিতান্ত বিনয়বশত একটি  অসার উক্তি। কেননা উৎপলের কবিতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশ্বসাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের অলিগলি কানাগলিসহ সকল প্রেক্ষিত ও দৃষ্টিপাত যেভাবে তিনি তুলে ধরেছেন তাতে প্রজ্ঞার অভাব কিম্বা দুর্বল বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানের উক্তি বিনয়বশতই করা হয়েছে - বুঝতে বাকি থাকে না।


প্রবন্ধ পাঠ উপন্যাস, গল্প কিম্বা কবিতা পাঠের মতো সাবলীল আনন্দদায়ক নয়। কিছুটা আয়াসসাধ্য ব্যাপার। পাঠকের মনে প্রবন্ধ পাঠের ক্লান্তিবোধ যেন না ঘটে সেদিকে বিশেষ নজর ছিলো লেখকের। প্রাঞ্জল ও ঘরোয়া ভাষায় গল্পের ছল, বইয়ের  বিন্যাস ও আয়োজন সেকথাই নির্দেশ করে। বইটিতে মোট ৬টি সেকশন আছে। কৈফিয়ত, লৌকিক মায়ার আঁতুড়ঘর, স্মৃতি কিঞ্চিৎ,  কথাবার্তা, চিঠি এবং গূঢ় সংকেতলিপি যত। 'লৌকিক মায়ার আঁতুড়ঘর' অংশে বিভিন্ন সময় লেখা লেখকের ৪ টি ভিন্ন স্বাদ ও ভাষার প্রবন্ধ, 'স্মৃতি কিঞ্চিৎ' অংশে কবি উৎপল কুমার বসুর ঢাকা সফরে লেখকের সাথে কবির স্মৃতিচারণ, 'কথাবার্তা' অংশে কবি উৎপল কুমার বসুর খুবই এক্সক্লুসিভ একটি সাক্ষাৎকার,  'চিঠি' অংশে সন্দীপনকে লেখা উৎপলের একটি চিঠি এবং 'গূঢ় সংকেতলিপি যত'  অংশে উৎপল কুমার বসুর বাছাই ২৫টি কবিতা স্থান পেয়েছে। বইটির এই বিন্যাস সম্ভব-সর্বোচ্চ উৎকৃষ্ট বিন্যাস বলে মনে হয়েছে। প্রথমে কবি উৎপল কুমার বসুর কবি ও ব্যক্তিসত্তার উন্মোচন এবং পরে তাঁর বাছাই ২৫ কবিতার উপস্থাপনের ফলে কবিতার রস আস্বাদন পাঠকের জন্য সহজতর এবং আনন্দদায়ক হয়েছে। 

জহির হাসান তাঁর বইটি উৎসর্গ করেছেন এমন চার কিংবদন্তির উদ্দেশ্যে যারা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক জাতীয় সত্তা গঠনে পুরোধা পুরুষ হিসেবে স্বীকৃত। এবং একই সাথে তারা ছিলেন অখণ্ড বাংলার সমর্থক পূর্ববঙ্গীয় রাজনীতিক ও কবি ।  মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল মনসুর আহমদ, জসীম উদদীন এবং আবুল হাশিম। দেশভাগের রাজনৈতিক বাস্তবতায় পূর্ববঙ্গীয় ভিটেবাড়ি ফেলে যাওয়া পরিবারের পশ্চিমবঙ্গীয় এক কবির কবিতা ও কবিতাভাবনা নিয়ে রচিত গ্রন্থের উৎসর্গ পাতার এই চার বিশিষ্ট নাম আমাদেরকে  দুই বাংলার সাধারণ ঐতিহ্য  ও যোগাযোগের দিকে ইঙ্গিত করে । 


কৈফিয়তের পর বইটির 'লৌকিক মায়ার আঁতুড়ঘর' অংশ পড়তে গিয়ে পাঠক হিসেবে এক অদ্ভুত মায়ায় আক্রান্ত হই। জহির  বলছেন- উৎপলের উপর কমলকুমার মজুমদার এবং সতীনাথ ভাদুড়ির প্রভাবের কথা। যখন 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' সম্পর্কে  বলেন- "সতীনাথের এই উপন্যাসের জীবন উৎপলের শৈশব-কৈশোরের দেখা ও যাপিত জীবনের তেমন দূরত্ব নাই"।  প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় –উৎপল কুমার বসুর “গদ্য সংগ্রহ-১ উৎসর্গ করেছেন এইরূপ বাক্য ব্যয়ে – ‘ ছেলেবেলায় ,বিছানায় শুয়ে শুয়ে , বহু ঘুমহীন রাতে শুনেছি চৌকিদার হেঁকে যাচ্ছেন “বস্তিওয়ালা জাগো” … “কোঠিওয়ালা জাগো” সেই অজানা, অদেখা, সাবধানকারি , নিশাচর মানুষটির প্রতি আমার এই অস্থিরমতি লেখা কালস্রোতে ভাসিয়ে দিলাম”  এই ঢাকা শহরে পাঠকের নিজেকে কবরে-বন্দী বলে মনে হয়। হাঁসফাঁস করে ওঠে ক্লান্ত শ্রান্ত দেহযন্ত্র। নিশ্বাস আটকে আসে। সাফোকেশন টের পাওয়া যায়। 


বইয়ের প্রারম্ভিক রচনায় জহির হাসান উৎপল পাঠের কিছু নোট পুরী সিরিজ পর্বতে উৎপলের কবিতায় স্থাপিত  লৌকিক মায়ার এমন খোলস-ভাঙা বিবরণ প্রদান করেছেন যে তা অন্য কারো রচনায় পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। উৎপলের কবিতার আড়াল এমনভাবে জহির এই অংশে ভেঙেছেন যে উৎপকবিতার অন্তরালের সব খুঁটিনাটি ভাবনা ও কৃৎকৌশল পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়েছে বিপুল বিস্তার নিয়ে। উৎপল কবিতাকে কবি ও পাঠকের একক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করেন। জহির হাসান উৎপলের কবিতা আলোচনা এবং উৎপলের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে এই প্রত্যয়ের প্রমাণ প্রদান করেছেন। একই সাথে উৎপলের অন্য সব অনালোচিত কবিতার ব্যাপারে জহির হাসানের পর্যবেক্ষণ কী তা জানার তৃষ্ণা জাগিয়েছেন।

কবিতায় অতিচেতনার কথা বলতে শোনা যায় নতুন কবিতা আন্দোলনের প্রধান ব্যক্তিত্ব বারীণ ঘোষালের কণ্ঠে। বারীণ ঘোষালের অগ্রজ কবি উৎপলকুমার বসু বলছেন যৌথ-অবচেতনার কথা। জহির হাসান থেকে উদ্ধৃত করছি- 


" চিন্তার ইতিহাস নাকি তিন রকমের কেন্দ্রিকতার মধ্যে ঘুরপাক খাইছিল যথা- আদিযুগের কসমোসেন্ট্রিক ( ব্রহ্মাণ্ডকেন্দ্রিক আদি চিন্তা, কার্যকারণ, সৃষ্টিরহস্য, মানুষ মরার পর কোথায় যায় এই রকম চিন্তা) চিন্তা, মধ্যযুগের থিয়োসেন্ট্রিক ( দেবদেবীকেন্দ্রিক চিন্তা- দেবদেবীদের উপর মানুষের বৈশিষ্ট্যারোপমূলক চিন্তা) আর আধুনিক যুগের লোগোসেন্ট্রিক ( জ্ঞানকেন্দ্রিক চিন্তা যার থাকি ইউরোসেন্ট্রিজম আসছে) এখন আমাদের মধ্যে এই তিন ধাঁচের চিন্তাই কাজ করে।  উৎপল বলতেছেন,  সমস্যা হলো কবি, শিল্পী ও ভাবুকদের নিয়ে। তারা কিছুই হারাতে রাজি নন। 'যৌথ অবচেতনের কথা যদি পরিস্কারভাবে বলি যে, এই তিনটি স্মৃতি মানে কসমোসেন্ট্রিক, থিয়োসেন্ট্রিক, লগোসেন্ট্রিক আমরা আমাদের মাথার মধ্যে রেখে দিয়েছি। এবং এই তিনটেতে আমরা অবাধ যাতায়াত করি। "  


উৎপল যৌথ-অবচেতনের ধারণা থেকে এক সময় মুক্ত হয়েছিলেন। দেহ- আত্মা, হৃদয় -প্রাণ সুফীবাদের আধ্যাত্মিকতা, সাথে নিটশে জীবনানন্দ দাশ মিলায়া এক ব্যাপক ও সুগভীর চিন্তাস্রোত তুলে এনেছেন জহির হাসান উৎপলের পুরী সিরিজ আলোচনা করতে গিয়ে। সেখানে যৌনতা, অজাচার, পবিত্রতা অপবিত্রতার প্রসঙ্গও বাদ পড়ে নাই।  বিবাহ ও প্রেমের এক টাসকি খাওয়া দর্শনও পাঠককে দিয়ে গিলিয়েছেন। উদ্ধৃত করার লোভ সম্বরণ করা গেল না -"উৎপল একান্ত সাক্ষাৎকারে আমারে বলছিলেন যে  প্রেমের মানব-মানবীর মধ্যে যে সম্পর্ক এ যাবত বাংলা কবিতায় উপন্যাসে বেশি বেশি আসছে।  যেই প্রেমের মধ্যে বিবাহের সম্পর্ক জিয়ানো থাকে। সেই প্রেমের ভিতর বন্ধুত্ব যেন সংকোচিত। যেই প্রেমরে আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিছে। কারণ তার পরিণতি বৈবাহিকতায় পর্যবসিত হইবার সম্ভাবনা রহিয়াছে। তাই প্রেম মূলত ছদ্মবেশি বিবাহ একটি ডিফেক্টো মর্যাদা পাইতে থাকে। সমাজ স্বীকৃত ব্যাপার, প্রায় লিগ্যাল একটা ব্যাপার।"  


উৎপলের পুরী সিরিজের কবিতা 'বোনের সঙ্গে তাজমহলে'  যদি পড়েন প্রেম বিষয়ক উৎপলীয়  এই প্রাচীন মানবিক প্রবৃত্তি মাথায় রেখে  তাহলে দেখবেন  প্রেমের প্রচলিত পরিধি ভেঙে পড়ছে ।  নতুন মিনিং এর উৎপত্তি ঘটছে। বহু দিন ধরে বন্ধ থাকা অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আলো পড়ার মতো। ভীতি জাগানিয়া। অনিশ্চিত। ঝুঁকিপূর্ণ। বিধ্বংসী। সকলে এটা নিতে পারবে না। কেউ কেউ পারবে। কিন্তু কাউকে না কাউকে তা পারতেই হবে। না পারাটা মানুষের জন্য প্রজাতিগত অসততা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না যে বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্যেই মানবপ্রজাতির বসবাস। এই ভবিতব্য অতিক্রম করা মানুষের অসাধ্য। তাই মহাকালের বিবেচনায় মানুষকে শঠতা থেকে মুক্তি দিতেই 'বোনের সঙ্গে তাজমহলে' কবিতার জন্ম হয়। 


লৌকিক মায়ার আঁতুড়ঘর অংশে লেখক উৎপলের কবিতা পাঠের বেশ কিছু চাবি পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন। যেমন উৎপল যে কবিতায় বাক্য নিয়ে খেলেছেন, বাক্যকে আক্রমণ করেছেন তার চমৎকার রহস্য-উন্মোচনী ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন জহির হাসান । আপাত বিচ্ছিন্ন অসংলগ্ন বাক্য সমষ্টির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা উৎপলীয় কাব্যকলার গোপন সূত্র আবিষ্কার করেছেন। এবং শেষে দেখিয়েছেন যে উৎপলের কবিতা পাঠককে  কীভাবে তাবুলা রাসার পথে টেনে নিয়ে যায়।  নির্বিকারত্বই যে প্রকৃতির ভাষা সেকথা জহির হাসানের বরাতে আমরা জানতে পারি উৎপলের কাছ থেকে।  

জহির হাসান উৎপল কুমার বসুর কবিতার ভাষা নিয়ে কথা তুলেছেন। বলেছেন - " কবিতার ভাষার ভারকেন্দ্র নাড়ায়ে সরায়ে দিছেন উৎপল। কলকাতার মান ভাষায় লিখা কবিতা এতদিন যেই পথে হাঁটছে উৎপল সেই পথ ঘুরায়ে দিছেন। উনি লিখছেন কথ্যে, মুখের ভাষায়, সাধুতে চলিতের ভেজালে, তথাকথিত লোকজ শব্দের লগে সাধুদিগের শব্দের বিয়া ও হাঙ্গা বসায়ে ছাড়ছেন। ভাষাকাতর এমন কবি জীবনানন্দের পর আর দেখা যায় না। " 


উৎপলের কবিতার আরেক বিশিষ্ট প্রবণতা হলো- কেন্দ্রহীনতা। কবিতায় নির্দিষ্ট কেন্দ্র নাই। জহির হাসান উত্থাপিত এই বিষয়টির সমর্থন পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের কবি গবেষক উমাপদ করের লেখাতেও - "কবিতায় আগাপাশতলা কোনও টোটালিটি নেই। খণ্ড যেন। আপাত লিংক-লেস প্রতিটি ছত্র। ছবিগুলো ভাঙা, টুকরোটাকরা, ভাব গঠিত হতে চেয়েও যেন পরের পঙক্তির অনিশ্চয়তায় গঠিত হতে পারছে না।" ( আবহমান পাঠ তেরো আকাশঃ উমাপদ কর) এই পরিস্থিতিটাকেই বলা হয়েছে ফাঁক বা স্পেস। উৎপল কুমার বসু সচেতনভাবে তা তৈরি করেন পাঠক কর্তৃক পুরণতব্য বলে। এভাবে পাঠককে নিজের মতো ফাঁকা স্থান পূরণ করবার সুযোগ দিয়ে কবি পাঠককে এক ধরণের স্বাধীনতা দান করেন। পাঠক তার বোধ-বুদ্ধি-রুচি ও প্রস্তুতি অনুযায়ী একেক রকমের মিনিং তৈরি করে নেন কবিতার। 


বইয়ের এর পরের অংশ 'স্মৃতি কিঞ্চিৎ'। এই অংশে বর্ণিত হয়েছে কবি উৎপল কুমার বসুর ২০০৬ সালে ঢাকা সফরকালে  লেখক জহির হাসানের সাথে তাঁর স্মৃতিকথা। ঢাকার তরুণ কবিদের সাথে আড্ডা। উত্তর আধুনিকতা, ফুকো দেরিদা, নজরুল, জসীম উদদীন,  দীনেশচন্দ্র সেন এবং রেনেসাঁ প্রসঙ্গ স্বল্পবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। লেখকের স্মৃতিতে পুরো আলাপটা থাকলে তা পাঠকের জন্য অমূল্য সম্পদ হতে পারত ধারণা করি ৷ তবে মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে জহির হাসান মারফত উৎপলের মূল্যবান মূল্যায়ন জানতে পারা যায়।  মাইকেল প্রসঙ্গে কবি জুয়েল মাজহার এক জায়গায় বলেছেন- মাইকেল বনজঙ্গল কুপিয়ে, ঢেলা ভেঙে মসৃণ করে, বীজ বপনের উপযোগী করে তুলেছেন ( বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে) । এই কথারই প্রতিধ্বনি পাই উৎপল কুমার বসুর কণ্ঠে। আর তা তুলে ধরেন জহির হাসান। উৎপল বলেন-' আমি মাইকেলকে বেশি গুরুত্ব দিই। আরো দেব। নিশ্চয় দেব। রবীন্দ্রনাথকে আমি শ্রদ্ধা করি। কিন্তু মাইকেলকে আমি ভালোবাসি।" উদ্ধৃতিটি যদিও বইয়ের পরবর্তী অংশ 'কথাবার্তা' থেকে নেওয়া কিন্তু প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হয়েছে 'স্মৃতি কিঞ্চিৎ' অংশেই। সে যাই হোক না কেন - ব্রাত্য রাইসু, মাসুদ খান, মজনু শাহ, তারিক টুকু প্রমুখের উপস্থিতিতে জার্মান কালচারাল সেন্টারের লাইব্রেরির বিকাল মিশ্রিত সন্ধ্যার আড্ডা, মধুর ক্যানটিনের আড্ডা, নিউমার্কেট গমন, কবির পূর্ব পুরুষের ভিটা বিক্রমপুরের মালখানগর ভ্রমণ স্থান পেয়েছে 'স্মৃতি কিঞ্চিৎ' অংশে। ব্রাত্য রাইসুকে উৎপল বেশ খাতির করছেন- ব্রাত্য রাইসুর প্রশ্নের উত্তরে উৎপল তাঁর  কলকাতার প্রিয় তরুণ কবি হিসেবে ফাল্গুনি রায়ের নাম উল্লেখ করছেন- ব্রাত্য রাইসু কথা প্রসঙ্গে জহির হাসানকে বলেছেন- উৎপল  নিজে ভালো লিখলেও ওনাদের কবিতা রুচি খারাপ-- আড্ডার এই সব অনানুষ্ঠানিক সংবাদ উঠে এসেছে এই অংশে। 


পরবর্তী অংশ 'কথাবার্তা'। এখানে স্থান পেয়েছে জহির হাসানের নেওয়া উৎপল কুমার বসুর একটি অসাধারণ সাক্ষাৎকার। সেখানে জহির হাসানের স্ত্রীর বড়ো ভাই অধ্যাপক জাহিদ হাসান মাহমুদও উপস্থিত ছিলেন। ২২ পৃষ্ঠার এই নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকারে মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ প্রসঙগের পাশাপাশি নজরুলের কবিতার উচ্চকিত শ্লোগানধর্মীতা, নিজের কবিতার নানা দিক, স্ট্রিট রিয়ালিটি, হার্ড রিয়ালিটি, কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ,  কবিতার ক্রমিক ও শিরোনাম, কবির সোশ্যাল রেস্পন্সিবিলিটি, পাঠক-কবির যোগাযোগ, কবিতার কোনো কোনো লাইনের প্রবাদে পরিণত হওয়া কবিতার জন্য খারাপ কিনা ইত্যাদি নানান প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।  


এরপর বইটিতে সংযোজিত হয়েছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা উৎপল কুমার বসুর একটি চিঠি। চিঠিটি ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারি তারিখে লেখা।  চিঠিতে প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা গুড়িয়ে দিয়ে নতুন ভাষা ও কার্তুজের মতো নতুন কবিতা নির্মাণের জন্য তরুণদের প্রতি যে  বিপ্লবী আহবান রেখেছেন উৎপল তা পাঠককে রোমাঞ্চিত করার বিপুল শক্তি ধারণ করে আছে নিঃসন্দেহে।  

আর এর পরের অংশেই সন্নিবেশিত হয়েছে উৎপলের বাছাই ২৫ টি কবিতা 'গূঢ় সংকেতলিপি যত' শিরোনামে। ব্যক্তি ও কবি উৎপল সম্পর্কে  নাতিদীর্ঘ আলোচনা শেষে এই বাছাই করা ২৫ কবিতার পাঠ পাঠকের জন্য বিশেষ আনন্দের। এই 'বিশেষ' কথার কথা নয়। আক্ষরিক অর্থেই এটি 'বিশেষ'।  যে কারো মনে হতে পারে এতকাল অন্ধের মতো পড়েছি উৎপলের কবিতা, এখন পড়ছি খোলা চোখ নিয়ে। সামনে সুবিশাল উৎপলীয় প্রান্তর। সেখানে ফলে আছে উৎপলীয় সমুদ্র।


অতি মূল্যবান মনোজ্ঞ এবং ব্যতিক্রমী ভাষা বয়নের এই বইটি প্রকাশ করেছে বৈভব। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ । ভেতরের পাতায় ইলাস্ট্রেশন করেছেন হীরণ মিত্র ও যোগেন চৌধুরী । প্রকাশকাল—ফেব্রুয়ারী ,২০২২ । মূল্য ৩৭০ টাকা।

No comments

FACEBOOK COMMENT