DEHLIJ

শিবু মণ্ডল

 রাস্কিন বন্ডের কয়েকটি কবিতা 

ও তার আড়ালের কিছু কথা 


শিবু মণ্ডল 



বিশপ কটন স্কুল থেকে সিনিয়র কেমব্রিজ স্কুল সার্টিফিকেট( এখনকার মাধ্যমিক এর সমতুল্য) পাশ করার পরে আওয়েন রাস্কিন বন্ড ফিরে এসেছে দেরাদুন। শিমলার আট বছরের হোস্টেল জীবনের অবসানের পর তার আশ্রয় হয় মা এডিথ্‌ ডরোথি ও সৎ পিতার সংসারে। পড়াশুনোর আপাতত এখানেই ইতি। মায়ের ইচ্ছে ছেলে এবার বাবার মতোই ব্রিটিশ আর্মি জয়েন করুক। আর ছেলের স্বপ্ন সে লেখক হবে। 

‘বোকার মতো কাজ কোরো না। লিখে তুমি তেমন কিছুই উপার্জন করতে পারবে না। এর থেকে ভাল তুমি ইংল্যান্ডে চলে যাও মাসির কাছে। ওখানে তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল!’ মায়ের চাপ বাড়তে থাকে। কোনোরকম সেনাবাহিনীতেই যোগ দিতে বন্ডের আপত্তি থাকলেও মায়ের বিলেত যাওয়ার প্রস্তাবটিতে তার কোনও আপত্তি ছিল না। বরঞ্চ একজন ভবিষ্যতের লেখক হিসেবে ইংল্যান্ড তার কাছে তো এক সম্মানের দেশ। তবুও বিলেত যাবার কোনও তাড়াহুড়ো ছিল না তার। দশ বছর বোর্ডিঙে (দুবছর মুসৌরি ও আট বছর শিমলা) কাটানোর পর সে চাইছিল অন্তত দশটি মাস মুক্ত বিহঙ্গের মতো কাটাতে। চিলেকোঠার ঘরে একলা বাস তার। সঙ্গি বলতে একটি সেকেন্ড-হ্যান্ড টাইপরাইটার,একটি চেয়ার,একটি টেবিল ও একটি মাটির কুঁজো। আর রোমাঞ্চকর ষোল বছরের দুচোখে লেখক হবার স্বপ্ন। মাঝে মাঝে বন্ধুরা ঘুরেফিরে আসে। বেড়িয়ে পড়ে ওদের সাথে। একসাথে সিনেমা দেখা, আশেপাশের নদী-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো ও পিকনিক করা যেমনটি আর সবার কিশোরকাল কাটে। তবুও এই রাস্কিনের মধ্যে যেন অন্য এক রাস্কিন উঁকি মারে অন্য কোথাও। সে খুঁজতে থাকে অন্য এক শহর। সে দেখে কোনও ব্যালকনির রোদে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। সে দেখে কোনও বটের ছায়ায় কুস্তীগিরেরা মল্ল অভ্যাস করে। সে দেখে সবুজ ভেদ করে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে দিনে হাতে গোনা দুয়েকটি ট্রেন আসে আর ফিরে যায়। কুলি ও টাঙ্গাওয়ালাদের ব্যস্ততা বাড়ে তার সাথে। আর ষ্টেশন থেকে একটু দূরে সারি সারি হাতে টানা রিক্সা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে রিক্সাওয়ালারা। এ সব দেখতে দেখতে তারা শহরের বাইরে চলে আসে। সেখানে বয়ে গেছে যমুনা নদি। তার থেকে বেরিয়ে আসা ক্যানালের জলে ধোপারা শহরের বাবুদের কাপড় কাঁচে। শাল-সেগুনে ভরা দুন উপত্যকায় তখন সবুজের ছড়াছড়ি। উপরের মুসৌরির পাহাড় থেকে পাতলা মেঘেরা দল বেঁধে নেমে আসে। রাস্কিন ভিজে যায়। তার মনে পড়ে মৃত বাবার কথা, তার মায়ের উদাসীনতা। মেঘেরা থাকে কিছুক্ষণ, তারপর আবার চলে যায় অন্য কোথাও। রাস্কিন ও বন্ধুরা ঢুকে পড়ে ঝুপড়ি কোনও চায়ের দোকানে। চা আর পকোড়ার স্বাদে আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে তারা। আর কিছুক্ষণ পরেই সূর্য দিনের শেষ চুমু খেয়ে এই শহরকে ছেড়ে চলে যাবে অন্য শহরে।তার আগে গোধূলির আলোয় ডুবে আছে সারা দুন উপত্যকা। এই ক্ষণজন্মা গোধূলির কী যে এক মায়ার টান! আর সে টানেই এই শহর তার কাছে এক অনন্যরূপে দেখা দেয়। সে আবিষ্কার করে শহরের মধ্যেই এক অন্য শহরকে আর রোমাঞ্চিত হয় সেই আবিষ্কারে। সেই শহর,তার হরেক নাগরিক, তার গাছপালা, রাস্তাঘাট, তার পশুপাখির অনন্য ও অপার সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেয় এক নিষ্পাপ কিশোরের মনে। তারা শব্দ হয়ে উড়ে বেড়ায় এক কবিমনের চারপাশে। রাস্কিন ঘরে ফেরার এক তীব্র টান অনুভব করে। সে ছুটে যায় তার চিলেকোঠার ঘরের লেখার টেবিলে। সময়ে সময়ে সে জায়গা বদলেছে। কিন্তু নিজের সেই ঘর বদলায়নি। আর এই জায়গা পরিবর্তন তার কাছে যেন গুটিপোকা থেকে ধীরে ধীরে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে প্রজাপতি হয়ে ওঠারই মতন। আর এমনই এক রূপান্তরের পর্ব হিসেবেই রাস্কিনের বিলেত যাত্রা। সন ১৯৫১। হেমন্তের বিষণ্ণতার মধ্যেই বন্ড তার প্রিয় শহর ও বন্ধুদের ছেড়ে পাড়ি দিল সাত সমুদ্রের ওপারে তার পূর্বপুরুষদের দেশে ভাগ্যসন্ধানে। দোলাচলে ভরা আঠারো দিনের সামুদ্রিক যাত্রার পরে S.S.Strathnaver  নামের বিশাল জাহাজটি যখন লন্ডনের টিলবারি ডকে গিয়ে ঠেকল রাস্কিনের মনে একদিকে পরিবার, বন্ধু, নিজের দেশ থেকে দূরে চলে যাবার জন্য মন খারাপ ও একা হয়ে যাবার ভয় আর অন্য দিকে ইংরেজি সাহিত্যের স্বর্গ তথা তার প্রিয় সাহিত্যিক শেক্সপিয়র, চার্লস ডিকেন্স, আর্থার কোনান ডুয়েলদের দেশে নিজের সাহিত্যিক সত্তাকে প্রস্ফুটিত করার নির্ভেজাল স্বপ্ন। মানসিক এই দ্বন্দ্বের মধ্যেই সে লিখে ফেলল একটি কবিতা!        

১। 

ধবধবে সাদা বিশাল একটি জাহাজ পাশ্চাত্যের দিকে ধাবমান,

আমি উঠে বসলাম তাতে।

শীতল ও ধূসর কুয়াশার মধ্যে সেটি ভিড়ল গিয়ে 

লন্ডনে টেমস নদীতীরে।

অথচ আমি দেখলাম একটি পুরনো শাল বৃক্ষের ছায়াতলে বসে 

শুধু একটি গরু বিশ্রাম নিচ্ছে এবং

একটি বালক নিজে নিজে গান গাইছে,

আর, তার সেই গানটিই হবে আমার জীবনসঙ্গীত। 


স্বপ্ন তো লেখক হওয়া। কিন্তু কী লিখবে সে, গল্প না কবিতা! দেরাদুনে থাকার সময় এলোমেলো কয়েকটি গল্প লিখেছিল যেগুলির মধ্যে কয়েকটি ছেপেছিল একটি লিটিল ম্যাগাজিনে তবে বেশীরভাগই বিভিন্ন পত্রিকার দ্বারা বাতিল হয়েছে। তবে তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য গল্প প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত Illustrated Weekly of India তে। সেই ‘The Untouchable’ গল্পটিই ছিল বলতে গেলে তার প্রথম প্রকাশিত গল্প। এর বাইরে সে যা নিয়মিত লিখেছে তা হল তার জার্নাল। কবিতার কথা তেমন মাথায় আসেনি। তবে এই বিলেতে আসার পর নানা কারণে তার স্বপ্ন গুলো ধূসর হতে লাগলো। এতদিন সে কেবল বাবাকেই মিস্‌ করেছে, চ্যানেল আইসল্যান্ডে আসার পর থেকে সে মিস্‌ করছে তার দেশ ভারতবর্ষ, সে মিস্‌ করছে তার দেরাদুনের বন্ধু সোমি, কৃষাণ,রণবীরদের। এক নতুন দ্বন্দ্ব তার মনে আঘাত করে সবসময়- সে প্রাচ্যের না পাশ্চাত্যের? এখানে আসার আগে মনে মনে রোমাঞ্চিত হত এই ভেবে যে সে তার পূর্বপুরুষদের দেশে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু এখানে আসার পর সে অনুভব করে এই দেশটি তার জন্মভূমি ভারতবর্ষের মতো নয়। এখানকার মানুষ ও জলবায়ু তো আলাদাই এখানকার গাছপালা, পশুপাখি, রাস্তাঘাট, বাজার সবকিছুই আলাদা। সে ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল। সে তো নির্জনে থাকতে পছন্দ করতো, নিঃসঙ্গ তো হতে চায় নি কখনো। তার উপর রোজগারের উদ্দেশ্যে কাজকর্ম করার পর লেখালেখির সময়ও তেমন পাচ্ছে না। তবুও রাতজেগে নিজের দেরাদুনের জার্নালগুলিকে গল্পের রূপ দেয় আর সেগুলি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপতে পাঠায়। অথচ সেগুলি আর ছাপা অক্ষরে প্রকাশ পাচ্ছে না। সবমিলিয়ে এক বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে তাকে। এ অবস্থায় একমাত্র সেন্ট হেলার লাইব্রেরীই এমন জায়গা যেখানে বসে সে একটু শান্তি পায় । উইকএন্ডের দিনগুলিতে তাই সে ছুটে যায় সেখানে আর ডুবে থাকে বইয়ের জগতে। একদিন এই লাইব্রেরীতেই সে খুঁজে পেল রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথের কবিতাই হয়ে ওঠে এই প্রবাসে তার প্রিয় বন্ধু, তার প্রাণের সহায়! রবীন্দ্রকাব্যই তাকে ভারতবর্ষের আত্মার অনুভূতির সাথে জুড়ে রাখে। সেই সাথে কবিতার প্রতিও তার এক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। আর অন্যদিকে ততদিনে আত্মীয়দের সাথে মনোমালিন্যের কারণে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। রাস্কিন চ্যানেল আইসল্যান্ড ছেড়ে চলে আসে লন্ডন। সেই সন্ধিক্ষণে লেখা তাঁর একটি কবিতা-  

২।

আমার কবিতা কে কিনবে?

আমি নীরব পাষাণের কাছে গিয়ে গাইলাম। 

ভয়ানক জবাব এলো

গম্ভীর সমাধিস্থ স্বরেঃ 

আমরা তোমার চোখদুটি কিনে নেবো

আমরা তোমার অস্থি ও হৃদয় কিনে নেবো

আমরা তোমার সব কিনে নেবো যতো আছে পুরনো পোশাক  

তোমার সমস্ত ঋণ আমরা শোধ করে দেবো 

দয়া করে শুধু তোমার কোনও কবিতা আমাদের ছাপতে বোলো না

তোমার বর্জ্য পঙক্তিমালা আমরা কিনবো না। 

 

লন্ডনে এসেই রাস্কিন প্রথমে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য একটি কোম্পানিতে কেরানীর চাকুরী নেন। শিমলার স্কুলের পুরানো এক বন্ধুর মাধ্যমে ( যিনি উচ্চশিক্ষার কারণে তখন লন্ডনে থাকেন) মাথা গুঁজবার জন্য একটি ভাড়া ঘরের ব্যবস্থাও করে ফেলেন। সময়টা বসন্তকাল হলে কী হবে ঘন কুয়াশায় ঢাকা লন্ডন শহর! কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারদিকের এই ধূসরতার মধ্যেই রাস্কিন কড়া নাড়তে শুরু করে ইংরেজি সাহিত্যের গড়ে। সব খারাপের মধ্যেও কিছু ভালোর সন্ধান থাকে। নিরাশার মধ্যেও আশার আলো সামান্য হলেও লুকিয়ে থাকে। ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির পটভূমিকায় লেখা সেই কিশোরের যাপনকথাই শব্দের ঘেরাটোপে পড়ে গিয়ে একটি উপন্যাসের রূপ ধারণ করেছে ততদিনে। তবে তাকে প্রকাশের যোগ্য করার জন্য চাই এক দক্ষ সম্পাদক। ডায়না অ্যাটহিল তেমনই লন্ডনের এক প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক। তিনিই রাস্কিন বন্ডের পাণ্ডুলিপিটি পড়ে প্রথম উৎসাহ দেখান। তবে তার আগে তিনি পাণ্ডুলিপিটি আরও ঘষামাজা করে নিতে চান। অফিস থেকে ফিরে রাস্কিন ব্যস্ত থাকে পাণ্ডুলিপি সংশোধনের কাজে। এর মধ্যেই একদিন বিবিসিতে তাঁর একটি গল্প পাঠের জন্য আমন্ত্রণ পেলেন। সদ্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া বন্ড আবার চনমনে হয়ে ওঠে। বন্ধুবান্ধবও হয়েছে দুএকজন ততদিনে। তাদের সাথে সিনেমা দেখা, ঘোরা ও আড্ডাও চলছে। তবে সে বেশি পছন্দ করে অফিস ফেরত পথে হেঁটে হেঁটে চার্লস ডিকেন্সের শহরকে নিজের মতো করে আবিষ্কার করতে। এভাবেই একদিন সে আবিষ্কার করে – সে প্রেমে পড়েছে! তবে এই শহরটির নয়। ভ্যু ফ্যুয়ং নামে তারই সমবয়সী একটি মেয়ের প্রতি। ভ্যু ফ্যুয়ং লন্ডনে পড়তে এসছে ভিয়েতনাম থেকে। ধূমকেতুর মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বন্ড যেন একটি কক্ষপথ খুঁজে পেল। সারাক্ষণ ভ্যু ফ্যুয়ংকে চোখে হারায় রাস্কিন। যখনই সময় পায় সে চলে যায় ভ্যু ফ্যুয়ং এর রুমে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা কার্ড খেলাতে মেতে থাকে। মাঝে মাঝে উষ্ণতা ছড়ায় চায়ের ধোঁয়া।একে অন্যকে একটু ছোঁয়ার বাসনায় জ্যোতিষীর অভিনয় করে। হাতের রেখা বিচার করে ভবিষ্যত গণনায় ও নানা কল্পনায় মগ্ন থাকে তারা। অবসরে অথবা ছুটির দিনে হাত ধরাধরি করে চলে যায় কখনো রিজেন্ট পার্কে অথবা প্রিমরোজ হিলে। সেই প্রিমরোজ হিলেই একদিন হাতে হাত রেখে ভ্যু ফ্যুয়ং বন্ডকে বলেছিল- ‘ভালোবাসি! ভালোবাসি তোমাকে!’ টিলার মখমল ঘাসে সেদিন কোনও ফুল না ফুটলেও রাস্কিনের জীবনে সেই প্রথম বসন্ত ফুটেছিল! সেই ভ্যু ফ্যুয়ং একদিন কোনও কিছু না জানিয়েই রাস্কিনের জীবন থেকে দূরে চলে গেল। রাস্কিন জানতেও পারল না সে হঠাৎ কোথায় গেল আর কেনই বা গেল! তবে ভ্যু ফ্যুয়ং চলে গেলেও তাদের ভালোবাসা রয়ে গেল রাস্কিনের কবিতার মধ্যে!         

৩।

প্রিমরোজ টিলাতে সে হাত রেখেছিলো আমার হাতে,  

সেই থেকে আমি তাকে ভালোবাসি, এখনো বাসি। 

যদিও শপথ করেছিলাম আমরা থাকবো একসাথে

সে সরে গেল দূরে আমার হৃদয় বিদীর্ণ করে। 

তথাপি এখনো ভালোবাসি তাকে আগের মতোই,  

আর এখনো দেখি সে উঠে চলেছে প্রিমরোজ টিলা ধরে।


জীবন থেকে প্রেম নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। লেখক হবার স্বপ্নও বেশ জটিল হয়ে পড়ছে লন্ডনে। প্রথম বইয়ের পাণ্ডুলিপি এখনও ফাইনাল না হওয়ায় তিনবছর পরেও বইটির প্রকাশ প্রায় অনিশ্চিতই বলা চলে। ফলে পূর্বজদের দেশের প্রতি যে ক্ষীণ মোহ ছিল তা দূর হয়ে গেল। রাস্কিন কাউকে কিছু না জানিয়ে একপ্রকার পালিয়েই চলে এল নিজের দেশ ভারতবর্ষে। যেন তাঁর কিছু ঋণ থেকে গেছিলো পূর্বজন্মের। সেই ঋণ মেটাতেই এসেছিল ইংল্যান্ডে। যখন এসেছিল তখন একরকম স্বপ্ন ছিল আবার যখন ফিরে যাচ্ছে তখন অন্যরকম স্বপ্ন নিয়ে ফিরে গেল সে। সাথে চার বছরের ঘাতপ্রতিঘাত সহ নানা ঘটনার অভিজ্ঞতা, কিছু স্বপ্ন-ভঙ্গ, আর প্রথম প্রেম হারানোর অভিজ্ঞতাও। রাস্কিন বুঝতে পারল যে লেখক হওয়া মানে শুধু খাতায় পেন দিয়ে কিছু শব্দের আঁচড় কাটাই নয়। বৃহৎ জীবনের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের যে দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত তাই একজন লেখককে পুষ্ট করে। এই সঙ্ঘাত, এই দ্বন্দ্ব তার চলতে থাকে দেশে ফিরেও পরবর্তী জীবনে নানা পর্যায়ে। তবুও নিজের শহর দেরাদুনে ফিরে আসার পর যেন সে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছে। সেই চেনাজানা মানুষগুলিকে দেখলে আর একলা মনে হয় না। সেই বাজার, রাস্তাঘাট, ছাদের ঘরে বন্ধুর মতো ঢুকে পড়া ময়না, বুলবুলি। আর গাছগুলিও প্রায় একইরকম আছে। সে আরও দৃঢ় হয় মনে মনে একমাত্র লিখে যাওয়াই তার পরিণতি।

ইতিমধ্যে লন্ডনের সেই প্রকাশনা থেকেই তার প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশ হয়েছে। নামীদামী পত্রপত্রিকায় একের পর এক ছাপা হচ্ছে গল্প ও ধারাবাহিক উপন্যাস। মাত্র বাইশ বছরেই সে একজন পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠিত লেখক। তবে লেখালেখি করে সামান্য আয় হলেও সেই আয়ের কোনও নিশ্চয়তা নেই। ভবিষ্যতের জন্য নির্দিষ্ট একটি উপার্জনের উপায় খোঁজা দরকার। ততদিনে তার মা,সৎ ভাইবোন ও সৎ পিতার সাথে দিল্লিতেই স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেছে। মায়ের পিড়াপিড়িতে চাকুরী নিয়ে আবার সে পাড়ি দিল দিল্লি। সম্মানজনক পদন্নোতির সাথে সাথে উপার্জনও বাড়তে লাগলো। তবে এই সম্পন্ন জীবন যেন তাকে তার স্বপ্ন থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। সে তো চায়নি ভালো চাকরিবাকরি করে থিতু হয়ে যেতে। সে তো লিখেই অতিবাহিত করতে চেয়েছে সারাটাজীবন। সে আবার ছেড়ে দেয় তার নিশ্চিত চাকরি। আবার সে শুরু করে তার একলা পথ চলা। পাকাপাকি ভাবে চলে আসে মুসৌরিতে। 

মুসৌরিতে এসে যে বাড়িটিতে সে ভাড়া থাকতে শুরু করে সেই ম্যাপলউড কটেজ বাংলোটি শহর থেকে একটু বাইরে। মেইন রাস্তা থেকে একটি ছোট রাস্তা নেমে গেছে Wynberg Allen School  এর পাশ দিয়ে ওক ও ম্যাপল গাছে ভরা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সেই বাংলোটির দিকে। রাস্কিন সারাদিন ডুবে থাকে লেখালেখি ও পড়াশুনাতে। আর তাতে ইন্ধন যোগায় সবুজ প্রকৃতির নির্জনতা। তারপর সন্ধে হলে হেঁটে হেঁটে চলে যায় উপরের বাজারে। ‘কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টে’র সন্ধ্যের চা-পান, আড্ডার পর একেবারে ডিনার সেরেই প্রতিদিন ঘরে ফিরে ব্যাচেলর বন্ড। তখন শীতের শহরের নির্জন রাস্তার সাথে কোনও যানবাহনের কথাবার্তা নেই, নেই বাতাসের সাথে স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খুনসুটি ও ঝগড়া। নেই গাছের ডাল-পাতার সাথে পাখিদের কলহ।তবে রাস্তার বাতিগুলি কিন্তু ভীষণ অভিমানী। পাহাড়ের ঢালু রাস্তার সাথে যে ওদের কী জটিল সম্পর্ক সে ওরাই জানে। কখনো জ্বলে কখনো মুখ ঘুরিয়ে থাকে। আর এমন আলো আঁধারির মধ্যেই একদিন ঘরে ফেরার পথে রাস্কিন দেখতে পেল তিনচারটি শেয়াল আপন খেয়ালে নাচ করছে। সে একটি গাছের আড়াল থেকে দেখে তাদের নাচ। তারপর তারা যেন রাস্কিনের উপস্থিতি টের না পায় এমন দূরত্ব রেখেই নিচে নেমে আসে সে। বাড়ির পথে কিছুটা আসার পরে রাস্কিন আবার পিছন ফিরে তাকায়। দেখে একটি শেয়াল সেই আলোআঁধারিতে তখনও নেচে চলেছে। পরদিন সকালে রাস্কিন লিখে ফেলল একটি কবিতা!                  

৪।

গতরাতে ঘরের পথে হেঁটে যেতে যেতে 

দেখি একটি শেয়াল একা 

নৃত্য করছে চাঁদের আলোতে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বুঝলাম

এই রাত্রিটি একান্তই তার, তারপর  

চেনা নিচু রাস্তা ধরে নেমে গেলাম।

সকালের শিশিরের সাথে যদি কখনো 

সঠিক তালে শব্দ বেজে ওঠে 

আমিও নেচে উঠি নিঃসঙ্গ শেয়ালের মতো!” 

  

তথ্য ও ঋণস্বীকার ঃ  Lone fox dancing, My Autobiography. Ruskin Bond 


No comments

FACEBOOK COMMENT