DEHLIJ

নলিনাক্ষ ভট্টাচার্য

রিসার্চ ফান্ডিং

নলিনাক্ষ ভট্টাচার্য



আশির দশকের গোড়ায় আর কে পুরম থেকে সরোজিনী নগর এলাম দুটো কারণে। এক, সরোজিনী নগর মার্কেটে সেই বিখ্যাত ওয়াটনি হোটেল আছে যেখানে ডাল-ভাত-তরিতরকারি থেকে মাংস-ভাত খাবারও ব্যবস্থা আছে। দুই, ওখানে বাবু মার্কেটে মাছ মাংসের বেশ কয়েকটি দোকান আছে যেখানে ট্যাংরা পুটি মৌরলা থেকে রুই কাতলা চিতল বোয়াল সব রকমের মাছ পাওয়া যায়। সপ্তাহের ছয় দিন নিজে রান্না করে মাছ ভাত খাই আর রোববার দুপুরে ওয়াটনিতে মাংস ভাত খেয়ে চাণক্যতে গিয়ে সিনেমা দেখে আসি। ব্যাচেলর জীবনে এর থেকে আর কী আনন্দ হতে পারে? আমার বাড়িওয়ালা চক্রবর্তী ইউপিএসসিতে কাজ করেন। পরিবারে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। মেয়েটি বড়, ক্লাস নাইনে পড়ে, ছেলে ছোট ও ক্লাস সেভেনে। চক্রবর্তীর স্ত্রী শুচিবাইগ্রস্ত মহিলা, সকালে একবার বাথরুমে ঢুকলে আর বেরোতে চায়না ফলে অনেক সময় আমাকে এবং চক্রবর্তীকে স্নান না করেই অফিসে দৌড়তে হয়।  

চক্রবর্তীর ছেলে বিমান হাতের কাজে খুব দক্ষ; ঘড়ি, রেডিও খারাপ হলে বাজার থেকে জিনিষ কিনে এনে নিজেই সারায়, এমনকি প্রেশার কুকার খারাপ হলে সে-ই ঠিক করে। ভবিষ্যতে ও যে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে সেটা বুঝতে কারও কোন অসুবিধা হয়না। ওর নতুন শখ বাড়িতেই ও টিভি তৈরি করবে, এর জন্য ও কোথা থেকে একখানা বই জোগাড় করে এনেছে। এখন কিছু টাকা হাতে এলেই ও বাজার থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে কাজে লেগে যাবে। 

চক্রবর্তী একদিন সন্ধ্যায় আমার ঘরে এসে বললেন, ‘ কী করি বলুন দেখি ভটচাজ্‌ মশাই। ছেলের মাথায় ভুত চেপেছে, বলে পাঁচশো টাকা দাও, আমি টিভি বানাব। আমি মশাই ইউ ডিসি, তিনশো তিরিশ টাকা মাইনে পাই, ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ, বৌ-এর ওষুধপত্রের খরচ, বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। আপনাকে ঘর ভাড়া দিয়ে এই পচাত্তর টাকা না পেলে আমার সংসার চালানো মুস্কিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ছেলে গোঁ ধরে বসে আছে, কী করব বলুন দেখি? আপনি যদি একটু বোঝান ওকে।‘

আমি একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে স্টোভে ডাল চাপিয়ে বিমানকে আমার ঘরে ডেকে নিলাম। কালো, পাতলা, লম্বা মত চেহারা বিমানের, চোখ দুটো খুব উজ্জ্বল। ব্রাইট ছেলে মনে হল আমার। এক নজর আমার ঘরের চারদিকে নজর বুলিয়ে নিল ও, তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে ও জিজ্ঞেস করল আমি কত মাইনে পাই। আমি একটু থতমত খেয়ে জানালাম আমি পাঁচশোর একটু বেশি মাইনে পাই। 

‘ আপনি তো এসিস্টান্ট, বাপির থেকে ভাল মাইনে আপনার,’ বলল বিমান।

‘ আমি মাথা নাড়লাম।‘

এর পরের প্রশ্নটা আমাকে আরও অবাক করে দিল।

‘ এত টাকা দিয়ে আপনি কী করেন কাকু?’

আমি এবার একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, ‘ ছোটদের এসব প্রশ্ন করতে নেই বিমান। বাড়িতে মা-বাবা ভাই বোন আছে তাদের জন্য প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে হয় আমাকে। এবার তোমার খবর বল। বড় হয়ে কী করতে চাও তুমি?’

‘ আমি রিসার্চ করতে চাই, আবিষ্কার করতে চাই নানা রকম জিনিষ। আমি এডিশনের মত আবিষ্কারক হতে চাই কাকু।‘

‘ বাঃ খুব ভাল। তোমার হাতের কাজতো খুব ভাল তোমার বাবা বলেছেন আমাকে।‘

বিমান এবার ঠোঁট ওল্টাল। ‘ টাকা না হলে এসব কাজ করা যায়না কাকু। টেলিভিশন তৈরি করব ভাবলাম কিন্তু বাপি টাকা দেবেনা। কী করে টেলিভিশন তৈরি করব আমি বলুন কাকু?’

আমি এবার একটু ইনিয়ে বিনিয়ে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে ওর বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ না হলে ঠিকই টাকাটা দিয়ে দিতেন উনি। বিমান কী বুঝল কে জানে বেজার মুখে উঠে চলে গেল। 


সে মাসের শেষ দিকে এক সন্ধ্যায় বাবু মার্কেটে বাজার করবার জন্য আমার বাক্সের ভেতরের খোপে হাত দিয়ে একটু অবাক হলাম। ওখানে একশো টাকার একটা নোট ছিল আর তার সঙ্গে ছিল কয়েকটা দশ টাকার নোট এবং কিছু খুচরো পয়সা। একশো টাকার নোটটা পুরো বাক্সটা তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পেলামনা। মনে করতে চেষ্টা করলাম ওটা কোথায় কীভাবে খরচ করেছি আমি, কিন্তু মনে এলনা। অফিসে যাবার আগে আমার ঘরের দরজায় বড় একখানা হ্যারিসনের তালা লাগিয়ে যাই কাজেই আমার অবর্তমানে কেউ যে এসে ঘর থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে যাবে তার কোন সম্ভাবনা নেই। হয়তো অফিস থেকে মাইনে নিয়ে বাসে আসার সময় পকেটমার হয়ে গেছে বা অসাবধানে পড়ে গেছে নোটটা ভাবলাম আমি। এমনিতেই বেখেয়ালি, ঢিলে ঢালা মানুষ হিসেবে আমার কুখ্যাতি আছে পরিবারে এবং বন্ধুমহলে কাজেই কারও দিকে আঙুল তুলবার সাহস হল না আমার। বস্তুত দু’একদিনের মধ্যেই এই ছোট অস্বস্তিকর ঘটনাটা আমি ভুলেই গেলাম। কিন্তু এর পর প্রতিমাসের শেষ দিকে আমার টাকার টান পড়তে লাগল। কোলিগদের কাছ থেকে মাসের শেষে একবার পঞ্চাশ টাকা ধার নিলাম আমি, আরেকবারতো আমার এমন অবস্থা দাঁড়াল যে খবরের কাগজ বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে আমার চাল ডাল কিনে খেতে হল মাসের শেষ কয়েকটা দিন।

আমার টনক নড়ল সেই দিন যেদিন চক্রবর্তীর ঘরে টিভির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমাকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁকি ঝুঁকি মারতে দেখে চক্রবর্তী হাসি মুখে আমাকে ভেতরে আসতে বললেন।

‘ দেখুন বিমানের কান্ড ভটচাজ্‌ মশাই। ইস্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করে টিভিটা তৈরি করেই ফেলল ব্যাটা। দেখুন দূরদর্শনে বিক্রম-বেতালের কাহিনি চলছে।‘

বিমানও হাসি মুখে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল, ‘ আসুন কাকু, দেখুন আমার টিভি কেমন হয়েছে।' আমার মনে হল ওর হাসির মধ্যে একটু ব্যঙ্গের রেশও ছিল যা একরকম আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া অঘোষিত চ্যালেঞ্জ বলেই মনে হল। ওর টিভি যে আমার টাকায় তৈরি হয়েছে সেটা আমি বেশ বুঝতে পারলাম। বিমান গুণী ছেলে, নিশ্চয়ই আমার তালার একটি চাবি তৈরি করে দুপুরে স্কুল থেকে এসে আমার ঘরে ঢুকে প্রতিমাসে একশোটি করে টাকা সরিয়েছে ও। কিন্তু ওকে চোর সাব্যস্ত করার জন্য আমার হাতে কোন প্রমাণ নেই। বিক্রমাদিত্য আর বেতালের এপিসোড শেষ হলে দুশ্চিন্তার ভুত কাঁধে নিয়ে আমি চিন্তিতভাবে আমার ঘরে ফিরে এলাম আর ওই রাত্রেই ঠিক করলাম সরোজিনী নগরে আমার আর থাকা চলবেনা। রোববার দুপুরে ওয়াটনি হোটেলে মাংস ভাত খাওয়া আর চাণক্যে গিয়ে সিনেমা দেখা আমার কপালে লেখেননি বিধাতা। 

পরের মাসে মাইনে পেয়ে পঞ্চাশ টাকা প্যান্টের চোরা পকেটে গুঁজে রেখে বাকি টাকাটা আমি ব্যাঙ্কে জমা করে দিলাম। এক সপ্তাহ পরে আমি শিফট করলাম জনকপুরিতে একটি খালি একতলা বাড়িতে আমার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু অমিতাভর সঙ্গে। অমিতাভ সব শুনে মুচকি হেসে বলল, ‘ এ ছেলে জীবনে অনেক উন্নতি করবে দেখে নিস তুই। ওর রিসার্চ ফান্ডিং-এ কখনো কোন ঘাটতি পরবেনা।‘

পাঁচ বছর পরে সেকশন অফিসার গ্রেডের পরীক্ষা দিতে গিয়ে লাঞ্চের সময় ইউপিএসসি-র লনে চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার দেখা হল। কুশল বিনিময়ের পরে একথা সেকথা বলতে গিয়ে চক্রবর্তী জানালেন উনি আর ঘর ভাড়া দেননা। ‘ কী বলব মশাই আমার এমনি কপাল যে আপনি চলে যাওয়ার পরে যে তিনটে ব্যাচেলরকে ঘর ভাড়া দিয়েছি কেউ তিন মাসের বেশি থাকলনা। শেষের যে ছেলেটাকে ভাড়া দিয়েছিলাম ওতো আমার ছেলেকে চোর বলে এমন গালাগালি করতে শুরু করল যে আমি  হাত জোড় করে ওকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বললাম। কী ঝামেলা বলুন দেখি? ঘরে তালা লাগিয়েইতো অফিসে যেত ও, তারপর কী করে ও আমার ছেলেকে চোর বলে?’

আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলামনা। আমার মত আরও কিছু ব্যাচেলর যে বিমানের রিসার্চ ফান্ডিং করে এসেছে সেটা বুঝতে কোন অসুবিধা হলনা। শুধু একজন এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ করায় চক্রবর্তীকে ঘর ভাড়া দেওয়া বন্ধ করতে হল।

‘ বিমান এখন কী করছে, চক্রবর্তীবাবু?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম ওনার কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে।

‘ ও চন্ডীগড়ে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়িরিং-এ ডিপ্লোমা করছে। সেকেন্ড ইয়ার, স্কলারশিপ পেয়েছে তাই আমাকে বেশি কিছু দিতে হয়না।‘

‘ খুব ভাল।‘ 

স্কলারশিপ না পেলেও বিমান যে সহপাঠীদের বাক্স থেকে ওর স্কলাররশিপ-এর টাকাটা কোন বিশেষ কায়দায় তুলে নিত সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ ছিলনা কিন্তু সেটা বলার প্রবৃত্তি হলনা আমার। আর বললেও উনি যে বিশ্বাস করতেননা সেটতো ওনার কথাতেই বুঝে নিয়েছিলামা আমি। 


   

       


1 comment:

  1. খুব মজার গল্প

    ReplyDelete

FACEBOOK COMMENT