DEHLIJ

ইমন ভট্টাচার্য

 সময়ের সনদঃ ‘জন- অরণ্য’ ও অন্য কিছু উপন্যাসঃ প্রতিক্রিয়া থেকে শিল্পে

- ইমন ভট্টাচার্য




ছায়া ঘনাইছে বনে বনে

গগনে গগনে ডাকে দেয়া

ছায়া ঘনাইছে বনে বনে১


এ গান তো প্রকৃতির গান, প্রেমেরও। তবে ‘জন অরণ্য’ ছবিতে এই গান এক অন্য আবহ নিয়ে আসে। এক করাল ছায়াকে যেন প্রসারিত হতে দেখি পর্দা জুড়ে, যা একটি যুগেরও ছায়া, যুগেরও সঙ্কট। সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ চলছে,  শংকরও এইবার বিলম্বিত সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পেলেন। অন্যদিকে দেশজুড়ে চলছে এক অদ্ভুত  সংকট। যার মধ্যে বেকার সমস্যাও অন্যতম। তাই এই সময় ‘জন-অরণ্য’-এর মত উপন্যাসকে আবার স্মরণ করা এক কৃত্য তো হতেই পারে।

জন-অরণ্য যাকে বলে এক ‘হার্ড- হিটিং’ উপন্যাস। সময়ের সংকট নিয়ে। ‘নীতিবোধ’ যদি অনুপস্থিত হয় একটি সমাজে, তবে তা আর মানব সমাজ থাকে না। হয়ে ওঠে অরণ্যানী। যেখানে কোন ‘ল’ গরহাজির। উপন্যাস প্রকাশিত হবার পরপরই সত্যজিৎ রায় ফোন করেন লেখককে। অন্যদিকে দুজন বেকার যুবক এসে হাজির হয় লেখকের দরজায় অনাদিবাবুর জামাইয়ের নম্বর চাইতে। তারা বুঝতে পেরেছে ‘জন-অরণ্য’ উপন্যাসের একটি অক্ষরও বানানো নয়।  এদেশে কোন ভবিষ্ম্যৎ নেই। তারা যাহোক একটা কাজ নিয়ে বিদেশে যেতে চায়। লেখক তাঁদের বোঝাতে পারেননি। তিনি এঁদের জন্য কিছুই করতে পারেননা, তাই যন্ত্রণা পেয়েছেন। সুতরাং, উপন্যাসের কলেবরের মতো এর ভূমিকাও যন্ত্রণা নীল হয়ে রয়েছে।

ভাবতে অবাক লাগে, শংকর কোনদিনই যাকে বলে progressive লেখক নন। বরঞ্চ বাণিজ্যিক লেখক হিসেবেই তার পরিচিতি। কিন্তু বারবার চেনা জিনিসকে আরেকটু তিনি চিনিয়ে দিয়েছেন। বাণিজ্যের জগৎ, অপরাধের জগৎ- নানা লুকিয়ে থাকা চেনা জগতের বুকে অচেনা জগৎ তিনি চিনিয়ে দিয়েছেন। তাই উঠে এসেছে চৌরঙ্গী, জন-অরণ্য, সীমাবদ্ধর মতো উপন্যাস। যাপিত অভিজ্ঞতা এত বেশি তাঁর লেখায় যে বারবার তার উপন্যাস থেকে  ফিল্ম তৈরি হয়েছে। 

একজন ঔপন্যাসিকের কাজ কি? অনেক কাজ। তার মধ্যে একটি  হল ‘অপর’ জীবন বা অন্যরকম জীবনের সাথে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। যাতে পাঠকের সংবেদন আর একটু বৃহৎ হয়। সেই কাজটি শংকর ধারাবাহিকভাবে করে গেছেন। এই বছরের ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি’, যা বহু বিলম্বিত, সেই স্বীকৃতিই দেয়। অফিস পাড়ার বিচিত্র চেহারা, তেজারতির বড়বাজার, দালাল, ব্যবসায়ী- এক অন্য জগৎ যেন দেখতে পাই এই লেখকের উপন্যাসগুলোতে। উপন্যাসের ভাষা ঝরঝরে, সোজাসুজি, সপাট। খুব বেশি উপমা-উৎপ্রেক্ষা, কবিত্বের যেন অবসর নেই। আছে ঘটনা, আছে চরিত্র, আছে গোটা একটা সময়।

যে সময়টা উঠে আসা জরুরি ছিল শুধু আভাগার্দ সাহিত্যে নয়, বাণিজ্যিক সাহিত্যেও। শংকর সেই কাজটি করতে চেয়েছেন, কতটা সফল হয়েছেন তা বোঝার জন্যই এই প্রবন্ধ। সমাজ- সংস্কৃতি- সাহিত্যের একটি খণ্ডকে উদ্দেশ্য করতে চাইছে এই লেখা।

সত্যজিৎ রায় ‘পথের পাঁচালি’-র স্ক্রিপ্ট লেখার কথা বলতে গিয়ে ‘Our Films, Their Films’ বইতে লিখেছেন, মূল উপন্যাসে তিনি পাচ্ছেন একটি পরিবার ও দুটি মৃত্যু। যা স্ক্রিপ্ট-এর মূল কাঠামোকে দাঁড় করাচ্ছে। জন-অরণ্যের  গল্পেও আমরা প্রথমেই পাই, একটি পরিবার ও একটি বেকার ছেলে। এই আয়োজন নিয়েই উপন্যাসের শুরু। ক্রমশঃ এই যুবকটি সমাজে, সংসারে একা হয়ে যাচ্ছে। তার মূল কারণ তার কোন চাকরি নেই, সে ক্রমহীন, বেকার।

‘বেকার’ এই বিষয়টি বাংলাসাহিত্যে অনেক আগে থেকেই উঠে আসতে শুরু করেছিল। এই বেকারত্বের জ্বালা নিয়েই বিষ্ণু দে লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতা ‘বেকার বিহঙ্গ’

“কৈশোরে ছিল ধর্মঘটের শখ

যৌবনে নয় মাস্টার, কেরানীও

বাস্তুঘুঘুর অন্নধ্বংস সার

মুরুব্বি নেই, গ্রাম্য সে উমেদার

এদিকে গরীব মন বরণীয়

বসন্ত আসে, পাত্রী যে কেউ হোক।”২


সমর সেন লিখলেন- ‘একটি বেকার প্রেমিক’

কবিতা-

“সকালে কলতলায় 

ক্লান্ত গণিকারা কোলাহল করে

খিদিরপুর ডকে রাত্রে জাহাজের শব্দ শুনি

মাঝে মাঝে ক্লান্ত ভাবে কি যেন ভাবি-

হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি

আর শহরের রাস্তায় কখনো প্রাণপণে দেখি

ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক

আর মদির রাত্রে মাঝে মাঝে বলি

মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও

পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো

হানো ইস্পাতের মত উদ্যত দিন

কলতলার ক্লান্ত কোলাহলে

সকালে ঘুম ভাঙে

আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে

বণিক সভ্যতার শূণ্য মরুভূমি৩


সত্তর দশকের অনেক আগেই তিরিশের কবিরাই এইসব কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। দুদুটো বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত তাদের দেখতে হয়েছিল। দেখতে হয়েছিল বোমার আতঙ্ক ও কালোবাজারি। চূড়ান্ত অর্থনৈতিক মন্দা। এর মধ্যেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস লিখেছেন, জীবনানন্দ কবিতা লিখেছেন। স্বাধীনতা আসার পরপরই উঠে আসেন পঞ্চাশের কবিরা। নতুন স্বাধীনতার আশাবাদ ছিল তাঁদের মধ্যে এবং ‘কৃত্তিবাস’কে কেন্দ্র করে খানিক রোমান্টিক, খানিক নৈরাজ্যবাদী ও মূলতঃ অনিন্দ্যবাদী এক কবিতাচর্যা ও জীবনচর্চায় তারা মেতে উঠলেন, তবুও শক্তিকে একসময় লিখতে হবে-

“সেবড় সুখের সময় নয়

সেবড় আনন্দের সময় নয়।”৪


এই কবিতার সূত্র ধরেই সত্তর দশকের সমাজ- সংস্কৃতির একটা রূপরেখা আমরা আঁকতে পারি। সত্তরের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক নিয়ে আলোচনা প্রভূত হয়েছে।


উপন্যাস, যদি তা কমার্শিয়াল উপন্যাস হয়, তা কবিতা থেকে অন্য ধারার। কবিতার স্থান কৌলীন্যের বিচারে খানিক উঁচুতে। মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় থেকে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়ে দ্রোণাচার্য ঘোষ পর্যন্ত দেখা গেছে ক্ষোভের উদ্‌গার। তুষার রায়ের কবিতায় আমরা দেখি হতাশা থেকে ক্রোধে উৎক্রমণ। নিজেকে তিনি ‘বজরংবলী’ বলে উপমিত করেছেন, যে জ্বলন্ত লেজের ঝাপটায় সমস্ত অন্যায়, অবিচার, কলুষতা পুড়িয়ে দেয়। তার হাত থেকে আমরা পেয়ে যাই ‘ব্র্যাণ্ডমাস্টার’এর মতো চটি বই যা আগুন প্রসবকারী।  

‘দেখে নেবেন’ কবিতায় বলেছেন-

“বিদায় বন্ধুগণ, গনগনে আঁচের মধ্যে

শুয়ে এই শিখার রুমাল নিভে গেলে

ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন পাপ ছিল কিনা।” ৫


‘আত্মায় ট্রিগারে হাত’ কবিতায় বলছেন-

“আজ আত্মায় ট্রিগারে হাত

সুতরাং চাঁদমারি

তোমার গোল চক্কর কারো

আজ কড়াক পিং বুলস্‌ আই বিদ্ধ করে

উড়ে যাবে প্রত্যেকটা নিরিখ

আজ আত্মায় ট্রিগারে হাত

আজ তারিখ মনে রেখো।”৬


বলছেন- “আমি আমার অসম্ভব রাগ ও রোয়াব নিয়ে গর্জন করবো / আর তোমার চাবুক ও শক্‌ এ নিয়ন্ত্রিত খেলা দেখাব।”৭


এ ভাবেই একটি যুগের ক্লেদ, হিংস্রতা, ক্রোধ উঠে আসে। এভাবেই ‘ছায়া’ ঘনায় বনে বনে।

‘জন অরণ্য’-এ বারবার ইন্টারভিউ। ইন্টারভিউ-এর প্রস্তুতির বিষয়টি আসে। আসে চাকরি, চাকরির প্রস্তুতি সংক্রান্ত বিষয়ও। সোমনাথের এক বন্ধু আছে, সুকুমার। সত্যিই সে সুকুমার, সরল কিন্তু দারিদ্র, অনিশ্চয়তার চাপে পিষ্ট। সোমনাথের থেকে তাকেই বেশি উদ্যোগী দেখা যায় চাকরির ক্ষেত্রে। শেষে সে এমন অবস্থায় আসে যখন তাকে দশ দিনের মধ্যে একটা চাকরি পেতে হবে। আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় সুকুমার। উন্মাদ হয়ে পড়ে। “জেনারেল নলেজ বাড়িয়ে যাচ্ছি”- হেঁকে বলে সে। আস্তে আস্তে সে ক্রমশ গুটিয়ে আসছিল। খানিক অতি উৎসাহ, খানিক আতঙ্ক, বিষন্নতা গ্রাস করছিল তাকে। তিনমাস পরে তার বাবা রিটায়ার করবেন, অনেকগুলো পেট বাড়িতে। হন্যে হয়ে, মরিয়া হয়ে সে চাকরি খুঁজছিল। ক্রমশঃ ধরা পড়ছিল তার উন্মাদ রোগের চেহারা। সে শুকিয়ে যাচ্ছিল। যার সঙ্গেই দেখা হোক সে একটা, দুটো থেকে অনেকগুলো জেনারেল নলেজের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছিল। 

সবাই বুঝতে পারে, সে পাগল হয়ে আসছে। সোমনাথও বোঝে, কিন্তু বন্ধুর অসহায়তাকে সে আড়াল করতে পারে না। ঘটনার মোড় এমন হয়, যে ব্যবসায় এজেন্সি পেতে ওপরওয়ালাকে একটি মেয়ে ভেট দিতে হয় সোমনাথকে। সে দেয়ও। দেখা যায়, সে তারই বন্ধু সুকুমারের বোন কণা। এবার সোমনাথের পাগল হবার পালা। বাড়ি এসে তার ফুঁপিয়ে কান্নার মধ্যে দিয়ে উপন্যাসটি শেষ হয়।

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসেও সিদ্ধার্থর বোন সুতপাকে গ্রাস করে নেয় বাদলের মতো ছেলেরা। স্বাধীনতার মোহে সুতপা বুঝতে পারে না, সে কোন পথে পা বাড়িয়েছে। দাদার কোন কথাই সে শোনেনা, কারণ সিদ্ধার্থ বেকার।

বেকার বিহঙ্গ, বেকার প্রেমিক, সোমনাথ বেকার, সিদ্ধার্থ বেকার। ‘বেকার’ শব্দটিই কি আশ্চর্য, কর্মহীন, যে কোন কাজে লাগেনা, সে ‘ক্ষমতা’ হীন ফলে অভিশপ্ত। বেকার সৃষ্টি করে রাষ্ট্র, বেকারের মূল্যনির্ধারণ করে সমাজ। যে মূল্যের পরিমাণ শূন্য।

আমরা এই বেকারের মুর্তিটি তুলে ধরতে গিয়ে অনেক কবিতা ও গদ্যের উদাহরণ দিয়েছি। আসলে উচ্চকোটির তথা এলিট সাহিত্য ও ‘জনপ্রিয়’ তথা বাণিজ্যিক সাহিত্য পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। একটির সাথে অপরটির প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে, আবার কখনো কখনো তা পরস্পরের পরিপূরকও বটে। একটি আরেকটিকে প্রভাবিত করে, একটির আঁচ অপরটির গায়ে লাগে। সত্তরের ক্ষেত্রে এসেছিল আন্তর্জাতিকতা এবং ক্রোধ, অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ। কবিতা থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে উপন্যাস তথা জনপ্রিয় মাধ্যমে।

বাণিজ্যিক উপন্যাসও তার সময়ের দায় এড়িয়ে থাকতে পারল না। যে চাকুরীজীবিতা উনিশ শতক থেকে বাঙালি পুরুষদের আদিমুদ্রা, দেখা যাচ্ছে বিশ শতকের শেষে এসে সময় তাকে ধারণ করতে অক্ষম। সময় ধসে পড়ছে, মূল্যবোধ ধসে পড়ছে, যুবসমাজ গুমরে গুমরে ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছে। একধরণের রেসিস্টেন্স হয়ে উঠে আসছে সাহিত্য।

একদল রাগী যুবক একত্রিত হচ্ছিল বাংলার বুকে। একটি রাজনৈতিক মতাদর্শকে সামনে রেখে তারা তৈরি হচ্ছিল আফ্রিদিদের ঘরে তৈরি বন্দুকের মতো। এই নকশাল আন্দোলন একটি সমান্তরাল গল্প, কিন্তু জন-অরণ্য উপন্যাসে আছে। সিনেমাতেও আরো বেশি করেই আছে সেটা।

‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তেও সিদ্ধার্থকে একটি দল টেনে নিতে চায়। সিদ্ধার্থ ঢোকেনা সেই দলে। কিন্তু এ ধরণের মতাদর্শের প্রাসঙ্গিকতাও উড়িয়ে দিতে পারে না সে।

এই সত্তরেরই শেষ ভাগে সিনেমার পর্দায় রাগী যুবক হিসেবে অমিতাভ বচ্চনের উত্থান ঘটে তার কারণ ছিল সময়ের চাহিদা। একটি যুগের উষ্মা যেন রূপ খুঁজে পেল তার মধ্যে।

আমরা মূলতঃ ‘জন-অরণ্য’ উপন্যাসকে কেন্দ্রে রেখে সাজিয়ে তুলতে চাইছি আরো কতগুলো পারিপার্শ্বিক টেক্সট, যাতে এই যুগের পটচিত্রটি বোঝা যায়। টেক্সটে নিবিড়ভাবে ঢোকার আগে।

‘জন-অরণ্য’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৩ সালে বই আকারে। আশেপাশের যে টেক্সটগুলোর কথা আমরা বলছি, তাতে কিন্তু বারবার আসে এই বেকারত্ব, চাকরি পাওয়া- না পাওয়া প্রসঙ্গগুলি এবং বেশি করে ‘ইন্টারভিউ’ বিষয়টি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ঘুণপোকা’ উপন্যাসে আমরা একটি অদ্ভুত ইন্টারভিউ দেখি। যেখানে কোনো ব্যাক্তির পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে নায়ক শ্যাম তিনজনের নাম বলে এবং দুজনের পরিচয় বানানো পরিচয় দেয়। প্রশ্নকর্তা বলে ‘দ্য থার্ড ওয়ান।’ শ্যাম বলে ‘দ্য থার্ড ওয়ান মাস্ট বি আনইম্পর্টেন্ট।’ এই ইন্টারভিউয়ের সারশূণ্যতা সে ভালোই বুঝতে পারে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসে দেখি ইন্টারভিউয়ের দীর্ঘ মিছিল তাদের অব্যবস্থার জন্য সদলবলে প্রতিবাদ করতে যায়, সিদ্ধার্থ কিন্তু দেখে যে পেছনে কেউ নেই।

‘সেই মুহূর্তে সিদ্ধার্থ একাই বুঝতে পারল, সে আসলে একা। তার পেছনের দলটা ঐ ভদ্রলোককে উঠে আসতে দেখে সরে পড়েছে।’

সিদ্ধার্থ ভাবে, তার সুযোগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে ভয় পায়। সে খুব একটা ভুল ভয় পায় না। 

মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ সিনেমাতে দেখি চাকরি হবার সমস্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সে চাকরি পায়না শুধু ‘ইন্টারভিউ’-এর উপযুক্ত কোটপ্যান্ট নেই বলে। শেষে ধুতি- পাঞ্জাবির ব্যাঙ্গাত্মক বহরে সিনেমাটি শেষ হয়। সেই দুর্ধর্ষ মন্তাজ কে ভুলতে পারবে। সুতরাং একটি সময়ের আবহে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ সবক্ষেত্রেই প্রায় বাধ্যত প্রতিক্রিয়া উঠে আসছিল রোষ ও বিদ্রোহ উঠেছিল।

‘The Romance of The State’ গ্রন্থে আশিস নন্দী বলছেন তিন ধরণের ‘Culture’এর কথা, সংস্কৃতির কথা

১) Culture as Resource

২) Culture as Life Style

৩) Culture as Resistance

আমাদের দেখার বিষয় ‘জন অরণ্য’ এই Culture as Resistance হয়ে উঠছে কিনা। উপন্যাসে ঢোকার আগে উপন্যাসের কিছু চোখে পড়ার অংশ এখন সাজিয়ে নেওয়া ভালো।

“আমি ভাই তোকে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি- সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা এসব কিছুই বুঝতে চাইনা। যে আমাকে চাকরি দেবে আমি তার দলে।”

“আমার বাবার তিনমাস চাকরি আছে, আমার পাঁচটা নাবালক ভাইবোন, দেশোদ্ধার করার সময় নেই আমার।”১০

“চেষ্টা করে যদি বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে পরিণত হতে পারে, তবে আমি কায়স্থ থেকে সিডিউল ট্রাইব হতে পারব না কেন?”১১

“একবার যদি সোমনাথ বুঝতে পারত এর জন্য কে দায়ী, তাহলে বেপরোয়া একটা কিছু করে বসত।”১২

“পনেরোটা পোস্টের জন্য ইতিমধ্যে একলাখ এপ্লিকেশন জমা পড়েছে।”

“চারশ টাকা মাইনের জন্য আড়াইশ টাকা পেমেন্ট আজকাল কিছু নয়। রেল, পোস্টাপিস, ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডে চাকরি এখন নিলামে উঠছে।”১৩

“সমাজটাও এক ধরণের অরণ্য। ইঁট, কাঠ, পাথর দিয়ে তৈরি এই অরণ্যে জঙ্গলের নিয়মই চালু আছে।”১৪

“আত্মহনন ছাড়া এ যুগের অভিমানী ছেলেগুলো আর কিছুই জানে না।”১৫

বাখতিনের বলা হাস্যের অনুষঙ্গ থেকে যদি সত্যিই উপন্যাসের জন্ম হয়ে থাকে, তাহলে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপে আগেই এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে সে হয়ে উঠছে পীড়া, কষ্ট তথা Agonyর বাহক। কষ্ট থেকেই এই উপন্যাসের শুরু হয় এবং শেষে উঠে আসে এমন এক সংকট, নৈতিক অবনমন যে, কষ্টের আর কোন বিমোচন সম্ভব নয়। এ এক এমন ট্র্যাজেডি, যাতে কোন ক্যাথারসিস সম্ভব নয়।

এইখানেই ‘জন-অরণ্য’ আলাদা। এখানে মোক্ষের সম্ভাবনা নাই। সংকট থেকে নতুনতর সংকট এর যাত্রা। রাতের পর এক গভীরতর রাত, যেন মেরুদেশের অন্ধকার। 

সোমনাথ ছাড়া আরো কতগুলি চরিত্রের কথা বলা দরকার এখনে। প্রথমতঃ সোমনাথের বাবা। রিটায়ার্ড। প্রথম দুই পুত্র প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠিত নয় শুধু সোমনাথ। তাকে নিয়েই তাঁর যত দুশ্চিন্তা।

আছে সুকুমার। এই উপন্যাসের সবচেয়ে ট্র্যাজিক চরিত্র। এই উপন্যাস পড়ে আর সবাইকে ভুলে গেলেও, সুকুমারের চরিত্রটি ভোলা যাবে না। ভোলা যাবে না তার পাগল হয়ে যাওয়া, ভোলা যাবে না তার বোনের শেষ অবধি বেশ্যাবৃত্তি।

বিশুবাবু সোমনাথকে ব্যবসায়ে উৎসাহিত করেন। কিন্তু শেষ অবধি এগিয়ে দেননা। ব্যাবসার চোরাবাজারে সে হারিয়ে যায়। বিশুবাবুর চরিত্র বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক। তিনি যখনই আসেন, এমনকি সিনেমাতেও অন্য সুর বেজে ওঠে। 

যে দালাল চরিত্রটি সোমনাথকে এজেন্সি পাইয়ে দেবার ভার নেয়, সেও এক অদ্ভুত চরিত্র। দালাল। সব ক্লায়েন্টের সম্পর্কে সব জানে। প্রত্যেকের জোর ও দুর্বলতা তার নখদর্পণে। তবে সে জানে টাকা ও নারীর কাছে প্রায় সকলেই কুপোকাত হয়।

এর বাইরে আছে সোমনাথের কমলাবৌদি। সোমনাথের একমাত্র আশ্রয়স্থল। তার বাবার কাছেও কমলা একমাত্র কথা বলার জায়গা। প্রসন্ন, সক্রিয়, আশ্রয়দাত্রী। জীবনের ভালোটুকু নিয়েই তিনি আছেন। সুকুমারকেও পছন্দ করেন তিনি। জীবনের অন্ধকার রন্ধ্রগুলো যে আছে, সে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন, বুঝতেও চান না। সত্যজিতের সোমনাথ তাই বলে- “তোমাকে বোঝানো খুব কঠিন বৌদি।”

এই সমস্ত চরিত্রগুলো নিয়ে তৈরি হয় একটি সমবায়। তারা পরস্পর ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত। উঠে আসতে থাকে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন, উচ্চ মধ্যবিত্তের জীবন- বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে যারা বদলাতে পারছে না। মাঝখানে ফেঁসে গেছে সোমনাথের মত চরিত্ররা।

সোমনাথের যে শিক্ষা ও বুদ্ধি আছে, সুকুমারের তা নেই। একটা গণ্ডীর মধ্যে তাই সে পাক খায়, তথা ঘুরে মরে এবং শেষে পাগল হয়ে যায়। খুব করুণ, নৃশংস তার এই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার বিষয়টি। অন্যদিকে সোমনাথ কিন্তু এই নিম্ন মধ্যবিত্তের গণ্ডী ডিঙিয়ে অন্য একটি গণ্ডীতে ঢোকে, ব্যবসার গণ্ডীতে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেও পার পায়না।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশের পর নামের চেয়ে বদনাম অনেক বেশি হয়। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ যদিও সত্যজিৎ বেছে নিয়েছিলেন সিনেমার জন্য, তাতেও নিন্দা কম হয়নি। কেন এই নিন্দা? শংকরের অন্যান্য উপন্যাসের চেয়ে ‘জন-অরণ্য’ অনেক কম পঠিত হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাদা রাস্তা, কালো বাড়ি’, শীর্ষেন্দুর ‘ঘুণপোকা’ বা ‘শ্যাওলা’, সমরেশ বসুর ‘বিবর’ বা ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস- সবকিছুর মধ্যেই একটা মূল কথা ছিল মধ্যবিত্ত যুবকের অবনমন, তার হতাশা, তার ফিরতে না পারার অবস্থানে চলে যাওয়া।

সোমনাথের কথাই যদি ভাবি, বন্ধু সুকুমারের বোনকেই যখন সে নিজেরই অজান্তে ভেট প্রদান করে। তখন ফুঁপিয়ে কান্নাই তার নিয়তি। যেহেতু সে পুরুষ, বেশীক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদতেও পারবে না। সে যতই এগোক, যতই বাড়ুক- বারবার তাকে ফিরে আসতে হবে এই অন্ধ-বিন্দুর কাছে, যেখান থেকে তার মুক্তি নেই।

যে Culture as Resource এর কথা আশিস নন্দী বলেছেন, যা স্বাধীনতাপ্রাপ্তির স্বপ্ন হিসেবে শুরু হয়েছিল, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তা এক ধরণের বিস্মৃতি বা Ammnesia এ পূর্ববর্তী ,প্রাণত্যাগের অ্যামনেশিয়া, ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তি, অবনমনগুলি ভুলে থাকার ব্যাপার। তার থেকেই সুখী সুখী  Culture as Life Style তৈরি হচ্ছে। যখন এই সবটা ভেঙে পড়ল সত্তর দশকে আমরা দেখতে পাই Culture as Resistance রাজনীতির মধ্যে, কবিতার মধ্যে।


দেখা গেল, এই দশকেও শংকরের মতো তথাকথিত ‘বাণিজ্যিক’ লেখকও তার সময়ের দায় থেকে সরে যেতে পারলেন না। পার্থক্য হল, শংকর রুদ্রপন্থী নন। তার বিদ্রোহ অনেক গোপনচারি, যা পাঠককে নিজেকে চেনায়। গল্পের অভিঘাতে পাঠককে নিয়ে যায় অনেকদূর, নিজের কাছাকাছি।

‘জন- অরণ্য’ সিনেমায় ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’ গানটি প্রকৃতির গান হয়েও এক অন্য মাত্রা পায়।


ছায়া> অন্ধকার

বন> জন- অরণ্য

অভিসার> পেশাগত অভিযাত্রা

আড়ালে আড়ালে দেওয়া নেওয়া> ‘দালালি’

আপনায় লুকায়ে> নিজের সম্মুখীন না হওয়া


এরকম অনেক অর্থগত বদল বা বদলের সম্ভাবনা দেখা যায়, যেখানে সোমনাথ বৌদির সামনে ‘দালাল’ বলে চিহ্নিত করে। চারদিক অন্ধকার। মোমবাতির আলো, যে আলো কোন উদ্ভাস তৈরি করতে পারছে না, বরং অন্ধকারকেই আরও করাল করে তুলছে।

এই ট্রাজেডিই ‘জন- অরণ্য’ এর বৈশিষ্ট্য। যেখানে মানুষ বাঁচার লোভে ‘free agent’ হতে যায়, এবং হয়ে ওঠে বাজারের দালাল। তাই এই উপন্যাসে কোন মুক্তির জায়গা নেই, ক্যাথারসিস নেই, আছে শুধু বিস্মৃতির অপেক্ষা।


  








উৎসনির্দেশ

১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতবিতান, শুভম, কলকাতা,সং-৩ ২০১৩, পৃ- ৩৭৭

২। বিষ্ণু দে, ‘বেকার বিহঙ্গ’, চোরাবালি, ‘বিষ্ণু দে-র শ্রেষ্ঠ কবিতা’, নাভানা, কলকাতা, ১৯৮৫, পৃ- ২৭

৩। বুদ্ধদেব বসু (সম্পা),আধুনিক বাংলা কবিতা, এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, সং-৫,১৯৯৮, পৃ- ১৯৭

৪। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শ্রেষ্ঠ কবিতা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা,সং-১৪ ,২০১২, পৃ- ৪৮

৫। তুষার রায়, ব্যাণ্ডমাস্টার, স্বভূমি, কলকাতা,সং-১, ২০০২, পৃ- ১৭

৬। তদেব ২১

৭। তদেব

৮। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, প্রতিদ্বন্দ্বী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা,সং-৩, ২০০২, পৃ- ৬৯

৯। তদেব

১০। শংকর, ‘জন অরণ্য’ দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা,সং-১৩, ১৯৭৬, পৃ- ১৬

১১। তদেব

১২। তদেব পৃ- ৩১

১৩। তদেব পৃ- ৩১

১৪। তদেব 

১৫। তদেব পৃ- ৩৯




ড. ইমন ভট্টাচার্য, অতিথি অধ্যাপক, বিহারীলাল কলেজ

ই-মেল- emonbhattacharya.111@gmail.com

হোয়াটস্‌অ্যাপ- ৬২৯৬০১৬০৬২



    




1 comment:

  1. ভালো লাগলো।খুবই বিশ্লেষক লেখা যেমনটি তুমি লিখে থাকো।তোমার লেখা অনেকদিন পড়ি নি।পড়তে চাই।

    ReplyDelete

FACEBOOK COMMENT